সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

ধর্ম, সংবিধান এবং জাতীয়তাবোধ

বেশ কদিন আগের কথা। আমি গভীর ঘুমে। খুব ভোরে আমেরিকার মিসিসিপি অঙ্গরাজ্য থেকে আমার এক পরিচিত-এর ফোন। গলায় একই সাথে তীব্র উচ্ছ্বাস এবং চাপা ক্ষোভ!

-ভাই, খবর শুনেছেন?

- কি খবর?

-আমাদের তো শুয়াইয়া ফেলছে!

-কোথায় শুয়াইছে?

- সংবিধানে!

-কিভাবে শুয়াইছে?

-সংবিধান পরিবর্তন করে দিয়েছে!

- সেটা তো ৮৮ সাল থেকেই শুয়ানো।

-এখন আরও পাকাপোক্ত করে শুয়াইয়া দিছে, ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে শুইয়া দিছে!

-এখন আমার কি করনীয়?

-আপনি ব্লগে-ট্লগে কিছু লিখেন।

-আমার লিখায় কি যায় আসে? ঘুম কি ভাঙ্গবে?

-না ভাঙ্গুক, তাও লিখেন। আমি মেইলে ডিটেল দিচ্ছি!

আমার এই পরিচিতের ঘুম ভাঙ্গাভাঙ্গির ব্যাপারে আমি কিছু করতে না পারলেও যে সে অসময়ে ফোন দিয়ে আমার সকালের আরামের ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত, এবং কিঞ্চিত ক্ষুব্ধ। এই ফোনের দরুণ, আমার পুরো সকালটাই নষ্ট!

১.
সেই নষ্ট সকালে আমার সদা সজাগ ল্যাপটপে উনার দুষ্ট মেইলটা পেলাম। মেইলে একটি খবরের কাগজে লিংক দেওয়া [১]। খবরটা পড়ে যা বুঝলাম, সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম “ইসলাম”, “বিসমিল্লাহ” এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। এ ছাড়াও নাগরিক হিসেবে “বাংলাদেশী” এবং জাতি হিসেবে “বাঙালি” জাতীয়তাবাদ অক্ষুন্ন রাখার বিষয়েও অভিন্ন মত দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছাতেই মোটামুটি এটা হয়েছে বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবর্তিত সংবিধান মোতাবেক ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও বিশেষ কমিটির সুপারিশে সকল ধর্মেরই সমান অধিকার থাকবে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মসহ অন্য সকল ধর্মই সমুন্নত রাখা হবে। এ বিষয়ে কমিটির সবাই প্রায় অভিন্ন মত দিয়েছেন।

২.
এখন প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের "রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম" হলে কি বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাবে??? নাকি "ধর্ম নিরপেক্ষতা" হওয়া ততোধিক যুক্তিযুক্ত হবে? নাকি সংবিধান-এ এ বিষয়গুলো থাকাই থাকাই উচিত না? অনেকে এই তিনটা বিষয়কে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন। ফেইসবুকেও আমাদের সংবিধানের মূল নীতিতে রাষ্ট্রধর্ম ''ইসলাম'' থাকবে না ''ধর্ম নিরপেক্ষতা'' থাকবে এ বিষয়ে অনেকেই বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন।

একথা সর্বজনবিদিত যে, ধর্ম নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। কিন্তু যখন এই বিষয়টি রাষ্ট্রের সার্থ্যের সাথে মিশে যায়, জাতীয়তাবোধের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়, তখন দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সবার মত আমারও এ বিষয়ে অভিযোগ, মতামত অথবা সুপারিশ করার অধিকার আছে।

একজন স্নেহময়ী মা কখনই তার নিজ সন্তানদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারেন না, সকল সন্তানই মায়ের কাছে সমান, সকল ছেলে-মেয়েই সমপরিমাণ স্নেহের দাবীদার। কোন মা তার একটি সন্তানের নামে বিশেষ সুবিধা, একটি সন্তানের নামে বেশি সুবিধা প্রদান করতে পারেন না। আমার দেশ আমার কাছে দেশমাতা। আমার দেশমাতা আজ তার সন্তানদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় বিভেদ করে দিচ্ছে অথবা তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেখানে আবার হাস্যকরভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মসহ অন্য সকল ধর্মই সমুন্নত রাখার কথা বলা থাকবে। যে সংবিধান সবার মত আমারও পড়ার অধিকার আছে, আমি যখন আমার দেশের সেই সংবিধানটি পড়া শুরু করব তা “বিসমিল্লাহ” দিয়েই পড়া শুরু করতে হবে! পড়ার শুরুতেই আমাকে বুঝে নিতে হবে, এর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আমি এ ধর্মের না, আমি এর অনুসারী না! আমি নিজেকে মাইনরিটি হিসেবে বুঝে নিতে হবে!! সেখানে আমাকে জাতীয়নীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা করে ফেলা হয়েছে!! একদল মেজরিটি আরেকদল মাইনরিটি বলে ভাগ করে ফেলা হয়েছে!! আর যেখানে সংবিধানের শুরুতেই একটি বিশেষ ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সকল ধর্মকেই সমুন্নত রাখার কথা কিভাবে বলা হচ্ছে? আজ আমি উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। দেশের ক্ষীন উপকারে হলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তিলে তিলে গড়ে তুলতেছি। যোগ্য নাগরিক হয়ে নিজেকে তৈরি করে দেশে গিয়ে তার প্রতিদান করার কথা ভাবছি, একটু হলেও দেশের অগ্রগতিতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার জন্য স্বপ্ন দেখছি। সেখানে আমার দেশমাতা সংবিধানে আমাদেরকে উপেক্ষা করে কি আমাদেরকে আলাদা করে দিচ্ছে না? আমাদেরকে সমাজের অগ্রগতিতে অসাম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার পথ রুদ্ধ (বা অনুৎসাহিত) করে দিচ্ছে না? কই, দেশের মানুষ যখন মুক্তিযোদ্ধের অসম চেতনা নিয়ে জীবন বাজি রেখে ধর্ম-মত নির্বিশেষে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তো কোন ধর্মচিন্তা মাথায় রাখে নি! বর্তমান ভিন্ন ধর্মালম্বী সন্তানদের আত্মীয়-স্বজন যখন অনভ্যস্ত, কম্পিত হাতে বেয়নেটে গুলি ভরে সম দেশপ্রেম নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিকিয়ে দিল, তখন তো এ ভুমিতে ৮৫% মুসলমান না ১৫% হিন্দু, এরকম সংখ্যাগত বিবেচনা আমলে/বিবেচনায় নেয়নি [২]! আর যদি কোন ধর্মচিন্তা থেকেই থাকে তখন, সেই ধর্মের নাম ছিল “মুক্তি”, মুক্তি ধর্ম নিয়েই সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিল, একযোগে, মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিরুদ্ধ সমান চেতনা নিয়ে। আমি যখন এদেশের হয়ে কাজ করব, দেশের প্রতিনিধিত্ব করব, তখন তো আমি ধর্ম চেতনাকে মাথায় নিয়ে করব না, করব একজন বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে। তাহলে কেন, একটা দেশের সবচেযে বড় কেতাব- সংবিধানে একটা নির্দিস্ট ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হবে আর অন্যান্য ধর্মকে সমুন্তত রাখার শিশুশুলভ বুঝ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উপেক্ষা করা হবে? একটু রাষ্ট্র কেন তাদের নিজের সবচেযে বড় অংশ জনগনকে নিজেই ভাগ করে দিবে? একটা রাষ্ট্রের একটা বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা মানে ওই ধর্মালম্বালীদের হাতে ৫১/৪৯ (আদতে পুরোটাই) ক্ষমতা তুলে দেওয়া। বংশপরিচয় দেখে যেমন চরিত্র আন্দাজ করা না, প্রতুলতা দেখে যেমনি শক্তিমত্ত্বা নির্ধারণ করা যায় না, তেমনি কোন ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ট এটা দেখেও ধর্মের মাপকাঠি নিরূপণ করা যায় না।

অন্যদিকে, রাষ্ট্র আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে। যেখানে সংবিধানই ধর্মপুষ্ট, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকতে দোষটা কোথায়? সংবিধান তো ধর্মের পক্ষে। তাছাড়া বাংলাদেশ তো গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র, ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়! তাহলে কেন গণতন্ত্র অর্থাৎ সমান অধিকার, সমান পৃষ্টপোষকতা নির্ধারণ করা হবেনা। অনেকে বলছেন, ৮৫% মুসলমান বলেই মুষলমান রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। কিন্তু, সংবিধান তো শুধু ৮৫% এর না, এটা পুরো ১০০% এর, সেই ১৫% বাদ যাবে কেন? তাহলে সমান মূল্যাযণ অর্থাৎ গণতন্ত্র কিভাবে নিশ্চিত হল?

কেউ কেউ বলছেন, এতদিন তো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই ছিল, কই এতদিন তো কেউ কোন কথা বলেনি? অথবা এতদিন তো কারো কোন সমস্যা হয়নি! তাদের উদ্দেশ্যে বলব, আমরা অতীত থেকে অবশ্যই শিক্ষা নেবো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অতীতকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে হবে! "ঘরের খেয়ে বনের" আর "দুনিয়ার খেয়ে আখিরাতের" মোষ তাড়ানো -- দুটোই অর্থহীন। অতীত থেকে শিক্ষা নিই কোনো ভুলকে ওমিট করতে, তাকে আকড়ে ধরতে নয়।

৩.
সকল রাজনৈতিক দলই নিজেদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে। জিয়াউর রহমান সফল ভাবে সংবিধানের মুল ৪ নীতির [৩] পরিবর্তন করে গেছেন। এরশাদ জিয়ার সেই পদাঙ্ক অনুসরন করে “রাস্ট্র ধর্ম” এনেছেন। তাদের উদ্দেশ্য একটাই ছিল, সহজে সংখ্যায় সর্ববৃহৎ ধর্মভীরু মধ্যবিত্ত সমাজের আস্থা অর্জন! সম্প্রতি হাইকোর্ট সামরিক আইনে ৮৮ এর সংবিধান পরিবর্তন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনকে অবৈধ ঘোষনা করেছে [৪]। সে সূত্রেই ৭২ এর সংবিধান পুর্নবহাল থাকবে। একথা সবাই জানেন, ৭২ এর সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। সেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। তাহলে এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন অবৈধ! আর তাই অবৈধ একটা রাষ্ট্রীয় নীতি কেন বহাল থাকবে? আমাদের অস্থির রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেশিরভাগ সময়ই জনমত সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়না। এটাও তখন পায়নি। এখন সুযোগ এসেছে বলেই কথাগুলো তুলে ধরা হচ্ছে। এরশাদ অসাংবিধানিক ভাবে এ কাজটি করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুন্ঠিত করেছে। এখন সুযোগ এসছে বলেই এখন আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। আবার কেউ কেউ বলছেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সত্ত্বেও তো কোন সমস্যা হচ্ছে না, তাদের উদ্দেশ্যে বলব, একজন বাবা যখন নিজের সন্তানের সাথে একজন পালক সন্তানও পালেন, তখন আর্থিকভাবে সমান সহযোগিতা করলেও প্রয়োজনের সময় অথবা বিশেষ মুহূর্তে দুটি সন্তানের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলা হলে ঠিকই নিজের সন্তানকে বেছে নিবেন। এখানে প্রশ্ন হল আনুষ্ঠানিকতার, বৈধ স্বীকৃতির। বিশেষ কোন রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় ঠিকই বাংলাদেশ সরকার কনস্টিটিউশনে উল্লেখিত ধর্মের প্রতি বায়াস বা দূবলতা প্রকাশ করতে দায়বদ্ধ থাকবে। যেসব প্রসঙ্গে “একটি” ধর্ম বেছে নেওয়ার প্রশ্ন আসবে রাষ্ট্র তখন ঠিকই সংবিধান সংবলিত ধর্মকেই বেছে নিতে বদ্ধপরিকর থাকবে। আজ ভারতে ৮৬% হিন্দু থাকা সত্ত্বেও ভারত সেকুলারিজম সংবিধিত (Sovereign socrialist secular democratic republic country) [৫]। তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। [প্রসঙ্গত: ভারত সেকুলার দেশ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদেকে ঠিকই মাইনরিটি হিসেবে পরিগণিত করা হয়, যা অবশ্যই গণতন্ত্রের পরিপন্থি! যা আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনই সাপোর্ট করিনা] তাছাড়া রাষ্ট্র যেহেতু নামাজ, রোজা, হজ্জ, কিছুই পালন করেনা, আবার পুজাও করে না, আবার রাষ্ট্রকে যাকাত দিতেও দেখিনি, আবার অঞ্জলী নিতেও দেখি না। তাহলে রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কি?? রাষ্ট্রের মানুষগুলোর হাজারটা ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের কেন?? ধর্ম থাকবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের! “সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধিলাভ” -এর জন্য বিভিন্ন মাধ্যম আছে, বিভিন্ন ওয়ে আছে। বিভিন্ন ধর্মই এখানে বিভিন্ন মাধ্যম। যে কেউ তার ইচ্ছেমত মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করার অধিকার আছে। পদ্ধতীটা সঠিক এবং ওই ধর্মীয় নিয়ম মেনে হলেই হল। এখানে কারো হস্তক্ষেপ করা তার প্রাইভেসী লংঘন করার মধ্যে পড়ে, ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার মধ্যে পড়ে। মানুষ জন্মসূত্রেই সাধারণত বাবা-মার ধর্মের অনুসারী হয়। কিন্তু তার মানে তাই না যে, তার ধর্ম পরিবর্তন করা অধিকার নাই? সবাই সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক মাধ্যম বেছে নিতে পারে, অন্তত সেই অধিকার তার আছে! সেটা যার যার নিজস্ব অধিকার। জন্মসূত্রে হিন্দু হওয়ায় হিন্দু ধর্ম নিয়ে তো লাফালাফি করার মানে নাই! মুসলমান ঘরে জন্ম নিলে মুসলমান হতাম। কিন্তু তখনও আমার পা-দুখানা বাংলার মাটিতে থাকত, তখনও তো আমি বাংলাদেশীই থাকতাম! একটি রাষ্ট্র্রের তার রাষ্ট্রপরিচালনা নীতিতে সেই ব্যক্তিগত বিষয় (“ধর্ম”) কে বেধে দিবে কেন? রাষ্ট্রের মূলনীতিকে বিবেচ্য হবে “জাতীয়তাবোধ”, “দেশপ্রেম”। সেখানে ধর্মবোধকে সংযুক্ত করা কি অপ্রাসঙ্গিক নয়? আমি আগেই বলেছি “ধর্ম” বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাব-মা (জন্মসূত্রে) -সূত্রে প্রাপ্ত [যদিও বীর্যের মধ্যে ধর্ম লিখা থাকে না], আর “জাতীয়তা” দেশ-সূত্রে অর্জিত। সেখানে দেশের পরিচালনা-নীতিতে বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত বিষয়টিকে নিয়ে না আসাটাই কি যুক্তিযুক্ত নয়? একথা অনস্বীকার্য যে, সবাই যে যে ধর্মের অনুসারী তার প্রতিই বায়াস থাকবে। আমিও একটি বিশেষ ধর্মের বলে সেই ধর্ম নিয়ে কথা বলছি এটা এখানে ভাবার কোন কারন নেই। আমি কোন বিশেষ ধর্ম নিয়ে কথা বলছি না, বলছি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে, রাষ্ট্রের “ধর্ম বিষয়কে” উপেক্ষা করা নিয়ে। আমি নিজে সঠিকভাবে ধর্ম পালন করি বলে মনে করিনা। আমরা যারা এই ব্যাপারটা নিয়া বাড়াবাড়ি করছি তারাও সবাই ঠিকমত নিজেদের ধর্ম পালন করে বলে মনে করি না। আমরা যেখানে নিজেদের ধর্মপালনে মনোযোগী নই, সেখানে একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনা নীতিতে সংযোজিত করা কতটা সমীচিন? দেশের একজন ভিন্ন ধর্মালম্বীর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম!!!! আজকের এই বাংলাদেশে যদি অন্য ধর্মালম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হত এবং সংবিধানের শুরুতে যদি সবাইকে তাদের ধর্মের মন্ত্র পড়ানো হত তখনও আমি এর তীব্র বিরোধীতা করতাম। একজন নির্দিষ্ট ধর্মের নাগরিক যখন চায় যে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকুক তার ধর্ম, তার এটা ও মনে রাখতে হবে, একজন অন্য ধর্মালম্বীরও তার মত অধিকার আছে রাষ্ট্রধর্ম তার ধর্ম চাওয়ার। এখন সবার মতামতকে রাখতে হলে প্রত্যেক দলের জন্য আলাদা সংবিধানের ভার্সন করতে হবে। সেটা কি সমীচিন হবে? সবোর্পরী বলব ধর্ম একটা ব্যক্তিগত ইস্যু, এটাকে কনস্টিটিউটে না আনাটাই উচিত। যখন দেশের কথা আসে তখন আর তা শুধু একটি বিষয়ের উপর বা কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপার থাকে না। এখানে সবার সমান প্রাধান্য থাকে, একটা “সমমনা এজেন্ডা” থাকে, বলা হয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একই লক্ষ্য এগিয়ে যাওয়া। ব্যক্তিগত ব্যাপার গুলো ব্যাক্তি পর্যায়েই থাকা উচিত। আর ব্যাক্তিগত ব্যাপারগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সকল ধর্মালম্বীদের। রাস্ট্র কখনোই কোন ধর্মের লোকজনদের ধর্ম পালনে কোন নির্দেশনা দিতে পারেনা। রাষ্ট্রের জন্য তো ধর্ম নয়, মানুষের জন্য ধর্ম, সুন্দর আর শান্তির জন্য ধর্ম। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবসময় মত, দল, ধর্ম নির্বিশেষে সবকিচুর উর্দ্ধ্বে উঠে নীতিমালা প্রণয়ণ করা উচিত। “ধর্ম ব্যক্তিগত আর রাষ্ট্র সামগ্রিক”।

৪.
আমার এক মুসলমান বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি, প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (PUBH) মদিনার সনদে ধর্মঘনিষ্ট কোন শব্দ ব্যবহার করেননি, কারন সেখানে অন্যান্য ধর্মমতের অনুসারীরাও ছিলেন বলে। একটা দেশ কখনও ধর্ম দিয়ে চেনা উচিত না, চেনা উচিত তার জাতি দিয়া। আর জাতি গঠিত হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ নিয়া। তাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ট হওয়ার কারনে কোন ধর্মকে রাষ্ট্রীয় করা উচিত না। একজন ব্যক্তি ধর্ম নিরপেক্ষ না হইলে বড় জোর পরিচিত দুই একজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু একটা রাষ্ট্র যখন বলে বসে, আমার ধর্ম ইসলাম, সেই মুহুর্ত থেকে ঐ দেশের বাকি সকল ধর্মের মানুষ “দ্বিতীয় শেণ্রীর নাগরিক” এ গণ্য করা হয়। একটা জাতি বা রাষ্ট্র তখনই সৃষ্টি হয়, যখন কিছু মানুষ একটা “common” বা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ধারনা/বিশ্বাস নিয়ে গড়ে উঠে। “বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান- সবোর্পরী আমরা সবাই বাঙ্গালী”-এটাই আমাদের কমন এজেন্ডা, সমমনা চেতনা। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মুল দায়িত্ব তার সকল নাগরিককে সমান গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করা। কিন্তু রাস্ট্র যদি নিজেই জনগণকে পৃথক “আমি মুসলিম” বলে পৃথক করে দেয়, তাহলে সমতা রইল কোথায়? আমরা তো কোন বিশেষ পরিচয়ে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। “হরে কৃষ্ঞ” বলে বা “আমরা ইসলামী” দিয়ে তো নয়। আমাদের এক কমন জাতিসত্ত্বা দিয়ে, সমমনা দেশপ্রেম দিয়ে, আমাদের জাতিগত চেতনাবোধ- মূলত “বাঙ্গালীত্ব” কে ধারণ করে। “আমদের আগে জাতীয়তাবোধ, তারপরে ধর্ম”। রাষ্ট্রের সংবিধান রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসের লিখিত রুপ। সংবিধান রাস্ট্র পরিচলনার মুলমন্ত্র। সেই লেখাতে বাংগালী পরিচয়ই মুখ্য, ধর্ম নয়। “সেক্যুলারিজম” এখানে এই জন্যই গুরুত্বপূর্ন। এর মাধ্যমে আমি আমার কমন দৃস্টিভঙ্গি “বাংগালীত্ব”নিশ্চিত করি এবং সেই সাথে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের সমঅধিকার প্রাপ্য বলে সবাইকে স্বীকৃতি দেই। সবোর্পরী যদি সত্যিই আমাদের দেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সবার জন্য সমান অধিকার বাংলাদেশের মুল লক্ষ্য হয়, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণ করা কখনই নিরপেক্ষ নয়, সেটা অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্ট। “ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র সবার”।

৫.
ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু ধর্মহীনতা নয়! তাছাড়া অনেকে বলেন সেক্যুলারিজম ( Part of capitalism ideology) আর নিরপেক্ষতা একই জিনিস। সত্যিকারার্থে “সেক্যুলারিজম” “'Neutralization regards of any religion” নয়! সেক্যুলারিজম হল: “The belief that religion should not be involved in the organization of society , education etc” [6]; অথবা, “Encarta dictionary: exclusion of religion from public affairs” [7]. এই ধর্মনিরপেক্ষতাটাকে “ধর্মহীনতা” বলে দেশের বৃহৎ অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠিকে উস্কানি দেয়ার তাই কোন মানে হয়না। রাষ্ট্র মানুষের ধর্ম পরিচয় দেখবে না, রাজনৈতিক কারনে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না, এবং ধর্মের কারনে কাউকে বঞ্চিত করা হবে না কোনো নাগরিক অধিকার থেকে। এই বিষয়গুলোকে এক ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতা বলে, যেখানে রাষ্ট্র ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় না খুঁজে মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে এবং তার নাগরিক অধিকারকে শ্রদ্ধা করবে। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হল “ব্যক্তিগত”, সেক্যুলারিজম হল “সমাজগত”!

"রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম" আর "ইসলামী রাষ্ট্র" এক কথা নয়। "ইসলামী রাষ্ট্র" মানে যে রাষ্ট্রে ইসলামী শরিয়া মোতাবেক শাসন ব্যবস্থা চালু আছে। সেখানেও অন্য ধর্মের মানুষ বসবাস করার অধিকার অর্জন করলেও তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি মোতাবেকই চলতে বাধ্য করা হবে! “ডেমোক্রাসী এডমিনিস্ট্রিসন সিস্টেমে” যা কখনই পড়ে না!! আর "রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম" মানে ওফিসিয়ালী জাতিকে বলে দেওয়া যে, রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী অথবা কখনও কখনও পৃস্ঠপোষক। আর “সেক্যুলারিজম রাষ্ট্র” হালো রাস্ট্র তার নাগরিকের ধর্ম বিশ্বাসের উপর হাস্তক্ষেপ করবেনা, এই নীতির একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্টপোষক হলে এই হস্তক্ষেপের সুযোগটা থেকেই যায়!! একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্তায় এই সুযোগ দেয়াটা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত? আমাদের দেশে "রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম" থাকলে হয়তো “ইসলামী রাষ্ট্র” হয়ে যাবে না ঠিকই, কিন্তু এই সুযোগের দ্বারটা খুলে দেয়াটা কি সমীচিন? দুজন ভিন্নধর্মালম্বী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রার্থনার একান্ত সময়টুকু বাদ দিলে, জীবন সংগ্রামে আর কোন পার্থক্য পাওয়া যায় কি? বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এতোদিনে ধর্মচিন্তা বাদ দিয়েছে, এশিয়াতেও আশাকরি মানুষ বুঝবে জীবনে আসলে পার্থক্য আনার চেয়ে ভালবাসা আনা বেশি জরুরী। সংবিধানে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন যাই রাখা হোক না কেন তাতে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে কি আসবে আর যাবে।

৬.
আওয়ামালীগ এতে সম্মতি দিচ্ছে নিশ্চিতভাবেই নিজেদের আখের গোচাতেই! আমার জানামতে আওয়ামিলীগের গঠনতন্ত্রেও রাষ্ট্রধর্মের কোন উল্লেখ নেই। নির্বাচন এলে আওয়ামীলীগ তো অবশ্যই, পারলে কমিউনিষ্ট পার্টিও ধর্ম বেচে ভোট পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। এত সহজে ভোটের ধানভরা জমিন দখলে নেওযার সুযোগ আর কিসে পাওয়া যেতে পারে? ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী তো এর উপর ভর করেই জীবিত! বাংলাদেশের মেজরিটিই গ্রামবাসী, দারিদ্রসীমার নিচে। আমি নিজে যখন বন্ধুদের নিয়ে গ্রামে যাই, তখন দেখি আমার শিক্ষিত বন্ধুরা গ্রামের সহজ-সরল লোকদের খুব সহজেই প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। যাই বলে, তারা তাই বিশ্বাস করে নেয়, সেখানে সরলতা তাদেরকে বিট্রে করে। আমাদের রাজনীতিবিদরা এই সুযোগকে কাজে লাগায়। ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করাটা খুব সহজ হয়ে যায় তখন! বাংলাদেশে কারন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্যই ধর্ম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর সঠিক ব্যবহার তারা করবেই। ভোটের আগে দুই নেত্রী পাল্লা করে মাথায় কাপড় দেয়া শুরু করে - ধর্ম বলতে সম্ভবত আমাদের নেতারা এবং একটা বিশাল অংশ শুধু এটুকুই বুঝি। মৌলবাদীরাতো তো এ সুযোগের উপরই নির্ভরশীল।

যদি রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ না হয় তাহলে কিভাবে ভিন্ন ধর্মালম্বী দুটি বন্ধু ধর্মনিরপেক্ষভাবে কাজ করবে?? এভাবে দেশকে কতটুকু সহায়কভাবে সাম্প্রদায়িকহীন পদ্ধতিতে এগিয়ে নেয়া সম্ভব? সম্ভব তো হবে কেবল একই চক্রে বারবার পাক খাওয়া। সর্বশেষে এটাই বলব, রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত রাখা হোক, অর্থাৎ ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে যত দূরে পাঠানো হবে ততই তো মঙ্গল, সেটা হওয়া উচিত সময়ের দাবী। শুভত্ব আর শুদ্ধতা দিয়েই ঋদ্ধ হোক সকলের জাতীয়তাবোধ।

৭.
আরেকটি কথা, নতুন সংবিধানে, নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশী’ ঠিক থাকবে। তবে জাতীয়তাবাদ ‘বাঙালি’ হবে। আবার জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবের নাম বহাল থাকবে। জাতীয়তাবাদ বাঙালি মানে তো সকল বাঙালি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ সবাই ইনক্লুডেড। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাস তো ৪০ বছরের নয়, সেটা হাজার বছরের। এই হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক সুযোগ্য ব্যক্তিত্ব আছেন, সকলকে কি বিবেচ্য করা হযেছে? নাকি শুধূ ১৯৭১ পরবরর্তী সময়কালীন বাঙ্গালীদেরই সম্পৃর্ক্ত করা হয়েছে?? ব্যক্তিগতভাবে তো, আমি জাতীয়তা “বাংলাদেশী” থাকার পক্ষে!

পরিশেষে কবিগুরুর গীতালী কাব্যগ্রন্থের [8] কয়েকটি চরণ দিয়েই শেষ করছি:

মোর মরণে তোমার হবে জয় ।
মোর জীবনে তোমার পরিচয় ।
মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজি ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর আনন্দ সে যে মণিহার
মুকুটে তোমার বাঁধা রয় ।
মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয় ।
মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয় ।
মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর বীর্য তোমার জয়রথ
তোমারি পতাকা শিরে বয় ।।

[গীতালী, ১৯১৪]

--এই পতাকা শিরে থাকুক সকল বাংলাদেশীর, আর সেটা হোক সমান জাতীয়তাবোধে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সকলের শুভকামনায়!

তথ্যসূত্র:

1. Manabjomin, 16 Feb, 2011 [http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&view=article&id=2964:2011-02-15-16-43-05&catid=48:2010-08-31-09-43-22&Itemid=82].
2. Bangladesh statistical info system, Bangladesh statistical board.
3.Bangladesh Constitution and its context, Khijir Khan.
4.Prothom Alo, June, 2010
5. Wikipedia, "India"
6. Oxford dictionary
7. Encarta dictionary
8. Gitali, Rabindranath Tagore, 1914.
Visit: http://artinapps.com আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শনিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১১

মুভি রিভিউঃ থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার

আজ সময় সুযোগ পেয়ে স্টেজভুউ তে দেখে নিলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর "থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার"। আপাতদৃষ্টিতে আমার ভাল লেগেছে সন্দেহ নাই। ছোট দাগে মানুষিক টানাপোড়েন আর অসহায় নারীর বাধ্য হয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করার কাহিনী নিয়ে ছবি "থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার"। মোশাররফ আর তিশার স্বভাবসুলভ ভালো অভিনয়। যথারীতি আবুল হায়াতের অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনয়। রুবার গায়ক বন্ধুর চরিত্রে বেমানান তপু। এ চরিত্রে আমার মনে হয় চন্ঞল মানাতো ভালো। হয়তো মেকার চরিত্রের চাহিদা থেকে বন্ধুবাৎসল্য এবং গানের কেমিস্ট্রিকে বেশি প্রায়রিটি দিয়েছেন। রুবার বোনের চরিত্রটি আমার কাছে সাবলীল মনে হয়েছে। কাহিনীবিন্যাসক দক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন নিসন্দেহে। বেশিরভাগ কারেক্টারের অভিনয় গতানুগতিক। কয়েকটি দৃশ্যে অযোচিত বাহুল্যের মেকি চেষ্টা। মুভির গানগুলো মানানসই হলেও আবহ সংগীতে তেমন বিশেষত্ব নেই। তবে বেশ কিছু সংলাপ চমৎকার। মুভির সবচেয়ে বড় দূর্বলতা নাটকসুলভ সিনেমাটোগ্রাফি। অন্যদিকে নতুনত্ব দেখাবার প্রচেষ্টা কল্পনার উপস্থাপনে। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর "থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার" ক্যনভাসে নিজের মুন্সিয়ানার পূর্ণ পরিচয় দিতে পারেননি যেরকমটা আমার প্রত্যাশা ছিল। হয়তো উনার মত খুব ভাল মেকারের কাছ থেকে আরও বেশি এক্সপেক্টশেন ছিল। অবশ্য সবমিলিয়ে বাংলা ছবির প্রেক্ষাপটে মুভিটি উপভোগ্য বলা চলে তবুও ধয্যং ধরানং আবশ্যকং!

প্রথমেই তথ্যসূত্র। গত ১১ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। ছবির কাহিনীকার আনিসুল হক, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, অভিনয়শিল্পী তিশা, মোশাররফ করিম, তপু, আবুল হায়াৎ ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্যান্য টীম। উল্লেখ্য যে ফারুকী এবং লেখক আনিসুল হক যৌথভাবে ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের তথাকথিত মূলধারার চলচ্চিত্রের গতানুগতিক কাহিনী ও সিনেমাটোগ্রাফী নিয়ে মধ্যবিত্ত দর্শকের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। তবে তাদের রুল-রুচির সাথে মানানসই ভিন্নধারার শৈল্পিক ও বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রও আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না, তা না। ইদানীং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত দর্শক কোন কোন ছবি দেখার জন্য দল বেঁধে সিনেমাহলে ঢুকছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটি তার মধ্যে হয়তো একটি।


এটাকে চিন্তাশীল ও বিশ্লেষণী ছবি হিসেবে আখ্যায়িত না করলেও, ছবিটির বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর খুটিনাটি বিভিন্ন দিকের জন্য ভালো লেগেছে। ফারুকী মূলত ভোগবাদী সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এখানে অর্থাৎ বর্তমান পরিবেশে একজন অবিবাহিতা নারীকে যে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এই ছবিটির মধ্য দিয়ে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে প্রৌঢ়দের অসংযত আচরণের দৃশ্যগুলিতে রুরার কৌতুকপূর্ন অভিলাশ একজন বাস্বব অসহায় মেয়ের পরিস্থিতির গুরুত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। আবুল হায়াতের সিড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অনেকটা বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হয়েছে। রুবাকে মাঝেমাঝে সাহসী মেয়ে আবার পরক্ষনেই অসহায় মেয়ের কারেক্টার দিয়ে মুন্ডিয়ে দেয়া হয়েছে যা মুল থিমের সাথে বেমানান বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। ঠিক যেমন রুবার বাস্তবতাবিবর্জিত স্বচ্ছল এবং স্বস্তিপূর্ণ জীবন কামনা করিনি (তপুর পারসপেক্টিভ ঘটনা)। তাছাড়া একটি টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে যাওয়া অসহায় মেয়ের পরিশীলিত পোশাকশৈলী অপরিপক্ক বলে মনে হয়েছে। চলচ্চিত্রকে চিত্তাকর্ষক করতেই বোধহয় পরিচালক এই কাজগুলো করেছেন।


ছবিটির ভালো লাগা দিকগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। ছবিটিতে দু’জন সঙ্গীর (তপু এবং মোশাররফ) মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার ব্যাপারে রুবার মধ্যে মানসিক টানাপোড়েনটা প্রদর্শনের জন্য মাল্টিপল পাসোর্নালিটির এডিশনটা (সো আদতে থার্ড পারসন প্লুরেল নাম্বার) ছবিটিতে একটা ভিন্ন আঙ্গিক দেয় নিসন্দেহে। তিশার মৃত মায়ের সাথে তিশার পরলৌকিক যাপিত ছবি (যে সপ্ন টা দেখে পুকুরের পাশে দাড়িঁইয়ে) পরিচালকের ভিন্নধর্মী সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয়। প্রথমবস্তায় নিজের মায়ের সাখে কর্কশ ভাষায় কথা বলা রুবা শেষে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় মায়ের ভুমিকাকেই প্রতিষ্টা দিতে চায়। মায়ের সাথে ছাদে রুবার কথোপকথনের দৃশ্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে, মায়ের চরিত্র রূপদানকারী কারেক্টারের অপরিপক্ক আড়ষ্ঠ অভিনয় বিরক্তির উদ্রেকই করেছে শুধু। এই গুরুত্তপূর্ণ চরিত্রে মহিলার সাবলিল অভিনয় প্রত্যাশা ছিল।


মূল কাহিনী: ফারুকী’র এই চলচ্চিত্রে রুবা একজন অবিবাহিতা নারী, যে মুন্না’র সাথে বসবাস করতো। কিন্তু হঠাৎই খুন করার অভিযোগে মুন্নাকে জেলখানায় বন্দী হতে হয়, আর তখনই একলা নারীর জন্য এই সমাজ কতটা সমস্যাসঙ্কুল তা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রুবা’র কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রুবার পুরনো বন্ধু তপু এক সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, এবং ক্রমশ রুবা তপু’র প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে। রুবার মধ্যে মানসিক টানাপোড়েনটা প্রকাশ এবং পরিণিতি পায় মাল্টিপল পাসোর্নালিটির কথোপকথনের মাধ্যমে।

এক পর্যায়ে তপু-রুবা একই ফ্লাটে থাকছে, আলাদা আলাদা রুমে। রাতের বেলা প্রথমাংশের এই সব বৃদ্ধদের মতই মিলনের ইচ্ছায় তপু রুবার রুমের সামনে ঘোরা ঘুরি করে, মাঝে মাঝে দরজা নক করে। রুবা সবই বুঝে কিন্তু সরাসরি সম্মতি দেয় না। ঠিক পরের দৃশ্যে, একই উদ্দেশ্যে রুবাকেও ঘোরা ঘুরি করতে দেখা যায়। ঠিক এই মূহুর্তেই রুবার সামনে হাজির হয় তার ১৩ বছরের মন। রুবাকে তপুর প্রতি শারিরিক আকর্ষণ হতে দূরে রাখতে রুবার মনের এক অংশ সবসময় রুবার সাথে ঝগড়া করতে থাকে। এই সমস্যায় রুবা মানসিক চিকিৎসকেরও কাছে যায়। প্রথমে মাঝে মাঝেই রুবা মুন্নাকে দেখতে যেত। কিন্তু চাকরি এবং তপুর কারনে সেটা ধিরে ধিরে কমতে থাকে, একপর্যায়ে মুন্নাই আর রুবার সাথে দেখা করতে চায় নায়। তপু রুবাকে পাবার আকাঙ্খা বার বার প্রকাশ করে যায়। রুবা বোঝে এবং এটাকে সে কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্য বলে মনে করে না, যেমনটা সে প্রথমের বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মনে করত। উলটা রুবা নিজেই তপুর আহ্ববানে সাড়া না দেবার কারনে অস্বস্থি বোধ করে। এক পর্যায়ে রুবা তপুর আকাঙ্খাতে সম্মতি জানিয়ে তপুকে তার ঘরে আসতে বলে। তপু লাফাতে লাফাতে হাজির হয় রুবার ফ্লাটে। গিয়ে দেখে রুবা নাই। রুবা আবার তার ১৩ বছরের মনের প্রভাবে তপুর কাছে নিজেকে সমর্পনে অসম্মতি জানায়।



আমর ক্রমশঃই ধারণা হচ্ছে যে সিনেমাটোগ্রাফীতে ফারুকী তার নিজস্ব একটি গন্ডিবদ্ধ অবস্থানে আটকে যাচ্ছেন। তার এই সিনেমার কাহিনীতে আমাদের নাগরিক জীবনের প্রেক্ষাপটে কিছু পরীক্ষামূলক কাজ করার চেষ্টা করলেও সেগুলো তার স্টেরিওটিপিকাল কাঠামোর বাইরে যেতে পারেনি। ছবিটির শেষাংশের অন্য নাটক/মুভিগুলোর মত সম্পর্কগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি এ বিষয়কে আরো বেগবান করে।

ছবিটা যেভাবে শুরু হয়েছে পরবর্তীতে তা সেভাবে পূর্ণতা নিয়ে এগোয়নি। কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া একটা মেয়ে কেন মাঝ রাত্রে পথে নেমে পড়বে তা বোধগম্য নয়। রুবা শিক্ষিত, সংস্কৃত। তার উচ্চ পর্যায়ের বন্ধু-বান্ধবও আছে। তাদের কাউকে ফোন করে নিয়ে যেতে বললেই চলত। আমার মনে হয় দর্শকের কল্পনাকে উসকে দিতেই এই দৃশ্যগুলো সাজানো হয়েছে। বলাবাহুল্য মোশাররফ করিম এখন টাইপড। যেভাবেই হোক তাকে সে রকমই দেখাতে হবে- এই প্রবণতা হালের পরিচালকদের মধ্যে দৃশ্যমান। মোশাররফের বাবা নিরাবেগ রোবটের মত যে রকম যাত্রার ঢঙে শাসন করলেন তা কাহিনীবিন্যাসকে খাপছাড়া করে। হঠাৎ করে তপুর মত প্রতিষ্টিত কারো আগমন অনাকাঙ্খিত ও দৃশ্যত আরোপিত। সর্বোপরি ছবির আখ্যানভাগ বাস্তবতা বর্জিত বলেই আমি মনে করি।


সাম্প্রতিক তথ্য: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটির জন্য ফারুকী সেরা পরিচালকের পুরষ্কার পেয়েছেন। ৮৩তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) প্রতিযোগিতায় ‘বিদেশি ভাষার ছবি’ বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটি [সূত্র: প্রথম আলো]। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবার ছবিটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এবার তিনটি ছবি জমা পড়ে। ছবিগুলো হলো জাগো, গহিনে শব্দ ও থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। এর মধ্য থেকে নয় সদস্যের অস্কার বাংলাদেশ কমিটি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটিকে চূড়ান্ত করেছে।

টক শো:
http://www.youtube.com/watch?v=Jd2QWnEveL4

ছবিটির একটি গান:
http://www.youtube.com/watch?v=LOIawofn_Aw

ফারুকীর ভাষ্য:
http://www.youtube.com/watch?v=9WYLn_KyDZg

শেষকথা: যারা এখনও দেখেননি, দেখার জন্য অনুরোধ করছি। লিংকটা নিচে দিয়ে দিলাম (তবে কপিরাইট আছে কিনা জানি না, ক্ষমা করবেন)। বলা যায়না আলসেমির জন্য আমার মত প্রথম প্রথম খোজাখোজির ঝামেলার মধ্যে নাও যেতে পারেন।

১. সম্পূর্ণ ছবি (হাই কোয়ালিটি)
২. সম্পূর্ণ ছবি
৩. ১২ মিনিটের সামারী


সর্বশেষে অযুত শুভাশিষ সকল শৈলারকে। ভালো থাকবেন।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শৈলী ই-বুক (প্রেম-বিষয়ক)

প্রেম-প্রীতি আসে নাই বা করেন নাই এমন মানুষ খুব কমই আছে! পার্থক্য শুধু রকমভেদে অথবা কালভেদে। কারও প্রেম বইয়ের নির্লীপ্ত সাদা পাতায়, কারও প্রেম বিকেলের বিস্তীর্ণ খেলার মাঠে, কারও প্রেম চাদঁনী পসার জোৎস্না রাইতের মৃদু আলোয়, কারও প্রেম কবিতার অঞ্জলীমাখা পরিশীলিত আবেগিকতায়, কারও আবার রাজনীতির টেন্ডারবাজী তেজী হকিস্টিক-এ, কারও কারও অফিস-টেবিলের নিচে হাত গলিয়ে উপরি উপঢৌকন হাতড়ানোতে, কারও অন্যের পিচে লাগামহীনভাবে লেগে থাকাতে। এর মধ্যে কোন কোন দুর্ভাগাদের প্রেম আবার তথাকথিত অভিলাষে। যে যার মত প্রেম করুক! আমাদের এত কোনই আপত্তি নাই। তবে একটা আর্জি আছে। প্রেম-সমেত আর্জি।

শৈলী প্রথমবারের মত কিছুটা রম্য ঘেষা ই-বুক বের করতে যাচ্ছে! তাও আবার ভালবাসা দিবসে। বোঝেন অবস্থা! নামও আবার দেওয়া হয়ে গেছে!: "শৈলী প্রেম-সংখ্যা"। বিশাল ব্যাপার! কিন্তু দুভাগ্যজনকভাবে মহা বিরক্তিকর কাজ "ব্যবস্থাপনার" দায়িত্ব দেওয়া হয়ে গেছে আমার কাছে। রাজ্যোর কাজ! প্রেমিকাকেও সময় দেওনেরও এখন টাইম নাই। নাওয়া-ঘুমানো তো দুরের কথা। এই সূত্র ধরে উপরে উল্লেখিত নানান জাতের নানান ক্যাটাগরীর প্রেমিকদের মধ্যে যারা কবিতা-প্রেমিক, গল্প-প্রেমিক, উপন্যাস-প্রেমিক, সবোপরী লেখা-লেখি-প্রেমিক, তারা দয়া করে অন্য প্রেম-প্রীতি ভুইল্যা গিয়া, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোমান্টিক ধারার লেখা দেন, আর আমাকেও তাড়াতাড়ি উদ্ধার করেন!

লেখা পাঠানোর ঠিকানা shoilyblog@gmail.com। অথবা এই পোস্টেও কমেন্ট আকারে দিতে পারেন। মনে রাখবেন ছোট লেখার কদর বেশি। আর ই-বুকটি হবে একটু রম্য-ঘেষা। বেশিরভাগ পোস্ট শৈলীর বর্তমান সাহিত্য ভান্ডার থেকেই নেওয়া হবে। পরিশেষে একটা ভালবাসায়-মোড়ানো চমৎকার একটি ই-বুকের আশায় বুক বাঁধলাম।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

জুলিয়ান সিদ্দিকী ভাই-কে জন্মদিনের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা

ইংরেজী নববর্ষের শুভদিনে শৈলীর প্রথমদিকের শৈলার জুলিয়ান সিদ্দিকী ভাইয়ের জন্মদিন আজ। এতুপলক্ষে মামদো ভুত ও শৈলী-র পক্ষ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। তয় জুলিয়ান ভাইয়ের বয়স কত হইছে কে জানে !?!
জুলিয়ান সিদ্দিকী




পাশাপাশি সবাইকে ইংরেজি বছরের শুভেচ্ছা!!

আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

ছবিব্লগ: স্বপ্নবাহুল্য ভ্রমনবিলাস

যেসব চরম চরম জায়গায় ঘুরাঘুরি করব বলে ঠিক করে রেখেছি, আজ সেগুলো সবার সাথে শেয়ার করতাছি। দেখেন দেখিনি কেমুন লাগে!

ডিসক্লেইমার: পড়বেন, দেখবেন, শুনবেন, বাট টিটকারী মারতে পারবেন না।

স্বপ্নবিলাস ১. এভারেস্টে বইসা বইসা সূযোর্দয় দর্শন:

আমার প্রথম এবং অন্যতম কাঙ্খিত স্বপ্ন হইল নিচের ছবিটিতে দ্রষ্টব্য এভারেস্টে পিকে আমার পদধূলিখান দেওয়া, তখন সময়টা থাকবে গোধূলিবেলা, সূর্যটা প্রায় ডুবি ডুবি, ম্লান লাল আভা ছড়িয়ে থাকবে চারদিকে, আমার হাতে ধরা থাকবে একটা ঝালমুড়ির প্যাকেট (কোকলা ব্র্যান্ডের হইলে ভাল হয়), আমি তখন চূড়ায় একটু ঢিগ দিয়ে বসে থাকব আর উপর থেকে ডুবন্ত সূর্যের দিকে অনেকক্ষন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব। কিতনা সুন্দর ফিলিংস হবে হতে পারে ভাইবা দেখেন?

দি হাইয়েস্ট চূড়া (লাল কালার) অব দ্যা এভারেস্ট
দি চূড়া (লাল কালার) অব দ্যা এভারেস্ট

ছবির বামের পর্বতটার নাম শুনছি অন্নপূর্ণা। ওইখানে যাওনের আপাতত কোন ইচ্ছা নাই, যামুই যখন, ছোটিমুটি না, একেবারে হাত্তির ডেলায় উঠুম গো। কানাঘুষা শুনতেছি, মুসা সাহেব নাকি তার এভারেস্ট-জয়ের প্রমাণ সো করতে তালবাহানা করতাছেন। এই সুযোগ-টাও কাছে লাগানো যায়। ফাঁকতালে পিকে উঠে এই খ্যাতাবটাও ইজিলি নেওন যায়। রথও দেখা হইল, আবার কলাও ব্যাচা হইল। আপনারা শুনে আরও খুশি হইবেন যে, আমি এ ভ্রমনের ব্যাপারে অনেকদুর আগাইয়াও গেছি। কাল রাত্রিতে গুগল ম্যাপ থেকে এভারেস্ট বেসক্যাম্পের একটা পাতা প্রিন্ট পর্যন্ত করে রেখে দিয়েছি। বুঝেন অবস্থা! এখন শুধূ দিনক্ষন ঠিক করনের পালা।

স্বপ্নবিলাস ২. ওয়াচিং দি ধরনী ফ্রম চান্দের মাটি:

এটা আমার অনেকদিনের একটা খায়েস। চান্দে হাইটা হাইটা পৃথিবী দেখুম। সারা পৃথিবীটা এক সাথে দেখতে কেমুন লাগে একবার দেখুম। এর থেকে মনোহর দৃশ্য আর কি হতে পারে! চান্দের মাটিতে দু'তিনরাত বিছানা পেতে ঘুমানোরও ইচ্ছা আছে। মনে মনে অনেকদুর ধরে প্রিপারেশনও নিয়ে রাখতাছি। চান্দে বাতাস-টাতাস নাই শুনেছি। রিস্ক নিয়ে লাভ নাই। কলে কলে তাই সময় সুযোগ পাইলেই কম শ্বাসে কেমনে বেশিক্ষুন থাকন যায় সেটা অনুশীলন করে রাখতাছি। সময় থাকতে সব ট্রেনিং নিয়ে রাখা দরকার। বলা যায় না, কখন হুট করে সুযোগ চলে আসে! চান্দে রাস্তা-ঘাট চিনতে একটু প্রবলেম হইতে পারে। এখানে গুগলের জিপিএস সিস্টেম খাকবে তো বলে মনে হয় না, দেখি কি করন যায়। একটা কিছু বের করতে তো হবে। যাব যখন ঠিক করে রেখেছি, অল্টারনেটিভ দেখে টেকে রাখাই ভালু।

চন্দ্রালোকে থাইকা ধরনী দর্শন
ওয়াচিং দি ধরনী ফ্রম চান্দের মাটি



স্বপ্নবিলাস ৩. আমাজনে জোৎস্না-স্নান:

কবিগুরুর ভাষায়, “আজি জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে”। সো ভরা জোস্না রাতে বনে যেতে হয়, এটাই নিয়ম। আর বন/জঙ্গল হিসেবে আমাজনটাই চুজ করে নিলাম। জঙ্গলটা খারাপ না, তাছাড়া বেশ বড়সড়ও আছে। যাওন যায় এখানে। বড়সড় জঙ্গলে ঢুকে জোৎস্না দেখার মজাই আলাদা হওনের কথা। ভরা চাঁদনি পসর রাইতে গভীর আমাজনে ঢুইকা গাছের উপর বসে বসে জোৎস্না স্নান করতে যে কেমন ভাল লাগবে, এটা চিন্তা করতেই তো আমার গা রিরি করতে আছে।

এইডারে কয় আমাজন জঙ্গল
এই দেখেন আমাজন জঙ্গল



স্বপ্নবিলাস ৪. টাইটানিকের সমাধিস্থল পরিদর্শন::

ছোটবেলায় ক্যামেরুন সাহেবের সিনেমাটা যখন দেখলাম তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখে দিয়েছিলাম, এখানে একবার যাওন যায়। সিদ্ধান্তটা ফাইনাল করে রেখে দিয়েছিলাম তখনই। ছোটবেলার শখ অনেক বড় ব্যাপার। যেকোন মূল্যে এটা রক্ষা করার চেষ্টা করা উচিত। একটা সাবমেরিন দিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের চারদিকে শুধূ একটিবার ঘুরব, এইই, আর তো কিছু না। আমার বড় প্রিয় শখ এটি। ইতিমধ্যে নেট-ফেট ঘাটাঘাটি করে যা জানলাম, ধ্বংসাবশেষটি নাকি এখন প্লাসিড প্লেসে আসে, সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৭,০০০ ফিট গভীরে। ইউএসের পেনসিলভ্যানিয়া নেভি সেকশান থেকে ‘অথলডি’ নামে একটা সাবমেরিন যায় সেখানে। এটা দিয়ে একবার ট্র্রাই মারন যায়। ইউএস যেহেতু, সাবমেরিনডা তো ভাল কোয়ালিটির হওনের কথা। পানির এত নিচে যামু যখন, দেখে শুনে বুঝে যাওন দরকার। আমি আবার সাঁতারও জানি না, কখন কি হয়, কওন তো যায় না!

টাইটানিক
এইডারে কয় টাইটানিক জাহাজ



পরিশিষ্ট:

আপাতত এগুলুই ঠিকঠাক করে রেখেছি। পরে সময় সুযোগ মত পরিমার্জন বা পরিবর্ধন হতে পারবেক। একটু তাড়াতাড়িই ভ্রমন শুরু করে দিমু ভাবতাছি। তবে এখনি বেরুনোটা মনে হয় ঠিক হবে না। সর্দি কাশির্র সিজন, কদিন যাক। তারপর ঝাপাইয়া লাগুম। আপনাদের দোহাত-মেলা দোয়া/আর্শীবাদ লাগবেক। সময় মত ভরাইয়া দিয়েন (আর ডিসক্লেইমারের কথা ভুলে যাইয়েন না কইয়া দিলাম)।

আরেকটা বাকি আছে, সেটা সিরিয়াস:

সবারই নানারকম শখ থাকে। আমারও আছে। তার মধ্যে একটা হল মরনকালীন শখ। আয়োজন করে মৃত্যকে উপভোগ করার শখ। আমি যখন মারা যাব, ঠিক তখন আমি চাই আবহ সঙ্গিত হিসেবে নিচের গানটা বাজুক। তখন থাকবে গভীর রাত। ঘরের সকল দরজা-জানালা খোলা থাকবে। বাতাসে পর্দা উড়তে থাকবে। ঘরে থাকবে শুধু একটি আধো-জ্বলা মোমবাতি। সেই মোমবাতির ম্লান আলোয় সবকিছু আবছা দেখা যাবে। সেদিন যদি হয় পূর্ণিমার রাত, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। জোৎস্নার আলো উপছে পড়বে আমার বিছানায়। আমার দূর্বল শরীর স্নান করব সে আলোয়। সে স্নানে ধুঁয়ে-মুছে যাবে আমার সকল অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি। সেই বিছানার ধারে শুধু আমার একজন প্রিয় মানুষ বসে আমার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকবে। তার ভালবাসার চোখের পানি আমার গালে টপটপ করে পড়তে থাকবে। জানালার ধারে ঝুলতে থাকবে একটি পাখির খাঁচা। বাইরে অনুচ্চস্বরে চাঁপাকান্না শোনা যাবে। তখন হুহু করে বাতাস বইতে থাকবে। একটু শীত শীতও করবে। ঠিক তখন আমার প্রানটা উড়ে চলে যাবে পরপারে। আর আমার প্রানটা যাওয়ার সময় খাঁচা থেকে পাখিটি মুক্ত করে দেওয়া হবে।

[বি:দ্র: তবে মনে করে ভাল করে যেন ঘরে এরোসোল স্প্রে করে দেওয়া হয়, যে হারে মশা বাড়তাছে, যেকোন সময় পুরা আনানন্দটাই মাটি করে দিতে পারে!!]

::::: Fazlur-Rahman-Babu---Shonai-Hay-Hayre-(Monpura-Soundtrack:::::::

গানটা ভাল লাগলে জানাবেন।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

রম্য: বিবাহঘটিত প্রশ্ন-সমাচার

আমার মাথায় কুলায় না, বিয়ে করে খাল কেটে কুমির আনার দরকার টা কি? বিয়ে করে কে কবে কি হতে পেরেছে? পৃথিবীতে যতো বড়ো বড়ো প্রেমিক- প্রেমিকা আছে লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা আমাদের দেবদাস এরা কেউ তো কোনো দিন বিয়ে করে নি। একবার ভেবে দেখেন তো এরা যদি বিয়ে করতো তাহলে কি আমরা মনে রাখতাম ? এরা কি জগৎ বিখ্যাত হতে পারতো? কিন্তু দেখেন কে শুনে কার কথা !?!! ভালা কতার আজকাল কোনু দাম নাই।!!!! আফসোস!!!

মেজাজ গরম। চূড়ান্ত ত্যক্ততার মধ্যি দিন যাপিত করতাছি। একখান অবধারিত প্রশ্ন শুনতে শুনতে মাথা ধরা। কারো সাথে দেখা হইল অথবা ফোনে কথা হইল (ইরেসপেক্টিভ অব আন্ডা বাইচ্চা অথবা আবাল বৃদ্ধবনিতা), ভালা বুড়া জিগাইবার আগেই সবার প্রথম প্রশ্ন, "কি রে, বিয়ে করেছিস??", "কি রে, বিয়ে করেছিস??" প্রশ্ন শুনতে শুনতে ঠোটের আগায় আমিও কথা রেডি রাখি। যারে যেরুম বুজানো যায় বুজায়া আইতাছি। কদিন আগে আমার থেকে ৮ বছরের ছোট, দুধের বাইচ্চা, ফোন ধরে প্রথমেই টিটকারি মেরে কয়, ভাইজান, ভাবী কেমন আছেন??... শালার.....(মাথার চুল ছিড়ার ইমো)....!!

ভাই, যারা এখনও বিয়ে করেন নি তারা ঘাবরাইয়েন না। আসেন আমরা সবাই একজোট হই, সবাই মিলে এক সাথে আওয়াজ তুলি, আমিতো বিয়ে করবোই না আমার ছেলেকেও বিয়ে করাবো না । আর, মরার আগে আমাদের নাতীকেও বলে যাবো, ভাইরে! তুইও বিয়ে করিস না।

এইবার কয়েকখান কৌতুক কান খাড়া করে শুনেন:

১.
জামান সাহেব তার নার্সারিতে পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে গেছেন চিড়িয়াখানায় । বিভিন্ন রকমের পশু-পাখি দেখে ছেলের তো কৌতুহলের বাঁধ ভেংগে গেছে । যেইটা দেখে হেইটা নিয়েই প্রশ্ন করে । বাবা এটা কি?

= এটা ঘোড়া ।
= বাবা ওটা কি ?
= ওটা গাধা ।
= বাবা গাধার পাশে ওটা কি ?
= গাধার পাশেরটা হচ্ছে গাধী ।

ছেলে তো অবাক! কোনটা কি এটা চিনতে না পারলেও গাধা গাধীর ব্যপারটা ও বুঝতে পারে না। তাই অবাক হয়েই বাবাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বাবা, গাধারা কি বিয়ে করে?

জামান সাহেব এবার নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলেন। মাথা চুলকাতে লাগলেন। তারপর চাঁপা একটা দীর্ঘ-শ্বাস ফেলে গাধার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে বাবা, গাধারাই বিয়ে করে !!!

২.
বিবাহবার্ষিকী নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা হচ্ছে—
স্ত্রী: তোমার কি মনে আছে, কাল আমাদের ১৩তম বিবাহবার্ষিকী?
স্বামী: হুমম, তো কী হয়েছে?
স্ত্রী: এই দিনটি কী করে পালন করব বলো তো?
স্বামী: তুমি কী করবে জানি না, তবে আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই মিনিট নীরবতা পালন করব।

৩.
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার পর স্বামী বাসা থেকে চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে মুঠোফোনে কথা হচ্ছে—
স্বামী: আজ রাতের খাবার কী?
স্ত্রী: বিষ আছে বিষ!
স্বামী: ঠিক আছে, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমার ফিরতে আরও দেরি হবে।

৪.
স্বামী: ওগো শুনছ, সর্বনাশ হয়ে গেল।
স্ত্রী: কী হয়েছে?
স্বামী: আজ মাইনে নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি আসার পথে দুই ছোকরা পিস্তল দেখিয়ে বলল, হয় টাকা দাও না হলে জান দাও।
স্ত্রী: আর তুমিও বোকার মতো টাকাটাই দিয়ে এলে!

৫.
: বাড়ি ফিরেই এক লোক দেখতে পেল তার স্ত্রীর হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। সে ছুটে তার কাছে গিয়ে কী হয়েছে জানতে চাইল। ‘গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছি …সকালে ঘরের কিছু কেনাকাটা করতে বেরুচ্ছিলাম …’
স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে স্বামী উত্তেজিত হয়ে বলল- ‘এত বিস্তারিত বলার প্রয়েজন নেই, এখন কী অবস্থা বল।’
স্বামীকে তার ব্যাপারে এত চিন্তিত হতে দেখে খুশি হয়ে স্ত্রী বলল- ‘আরে এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই, মাথায় দুটো সেলাই পড়েছে আর কবজি সামান্য একটু মচকে গেছে। অবশ্য ডাক্তার বলেছে …’।
এবার স্বামী আগের চেয়েও জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘আরে তোমার কথা কে জিজ্ঞেস করল? গাড়ির কী অবস্থা সেটা বল ।’

৬.
মৃত্যুশয্যায় শায়িত স্বামী তার স্ত্রীকে বলছেন—
স্বামী: আমি তো আর এক মাস পর মারা যাব, তাই আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর তুমি সাজ্জাদ সাহেবকে বিয়ে কর।
স্ত্রী: সাজ্জাদ সাহেব! বলো কি, সে তো তোমার শত্রু। আর তাকে কিনা বিয়ে করতে বলছ তুমি!
স্বামী: আমি জানি সে আমার শত্রু। সাজ্জাদকে শায়েস্তা করার এটাই তো মোক্ষম সুযোগ, বুঝলে?


৭.
উকিলঃ সেকি ম্যাডাম ? আপনার স্বামী তো পাচ বছর আগে মারা গেছেন । তাহলে চার বছরের আর একটি দুবছরের বাচ্চা এলো কোথা থেকে ?
ভদ্রমহিলা রাগের স্বরেঃ তা আমি তো বেচে আছি না কি?
-
-
-
-
-
পাদটিকা:

আঙ্গুর

ফল

আজকাল

বেশি

বেশি

টক!

8-)
বি
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

যুদ্ধাপরাধী বিচার সহায়তা

আজ মশলা মাখিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কারন বিষয়টা মশলা মাখিয়ে বলার মত না। তাই সোজা-সাপটা বলতে চাচ্ছি। যুদ্ধাপরাধী বিচার শুরু হতে যাচ্ছে, আমরা সবাই জানি। যুদ্ধাপরাধীদের পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে এও আমরা জানি। তাদের পা কাঁপাকাঁপি আরও আরেকটু বাড়িয়ে দিতে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার ফোরাম, সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর/ জাতীয় যাদুঘর, নানা অনলাইন ফোরাম (বিভিন্ন বাংলা/ ইংরেজী ব্লগ, জেনোসাইড-বাংলাদেশ/ওয়ার ক্রাইমস স্ট্রাটেজী ফোরাম), এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্মৃতিকথা/ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা বই/যেকোন ধরনের ডকুমেন্ট সংগ্রহকারীরা উঠেপড়ে লেগেছে।

আমরাই বা পিছিয়ে পড়ব কেন? আমরা সবার শেষেরটার অংশীদার হতে চাচ্ছি। বিচারকার্যে ৩৯ বছর আগের ঘটনার ক্ষেত্রে যথাযথ মিডিয়া প্রমাণাদি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করবে নি:সন্দেহে। মিডিয়া মানে এখানে আমি অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমেকে বুঝাচ্ছি। সেইসব ভিডিও সংগ্রহ করার কথা বলতেছি যেগুলো প্রকৃত অর্থেই বিচারকার্যে সহায়তা প্রদান করতে পারে তদন্ত কমিটিকে। সহজেই অনুমেয়, সেটা সহজ কাজ হবে না। আমি নিজেও ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে তা বুঝেছি। সবগুলো ভিডিও, অডিও লিংক আমরা পাঠাতে পারব তদন্ত কমিটি সংলিস্ট কোন ফোরামের কাছে। এক্ষেত্রে সবার সাহায্য কাম্য। কারো কাছে যদি একটিও নির্ভরযোগ্য লিংক থাকে, জানানোর জন্য অনুরোধ থাকল। তবে নিরপেক্ষ ও বিচারকার্যে গ্রহনযোগ্য একটা লিংক ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য, নিরপেক্ষভাবে, রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে, আবেগের আধিক্যের চাইতে চাঁছাছোলা নগ্ন সত্যকে তুলে ধরে এমন লিংক-কে বেছে নিতে হবে। নিম্নে আপাত দৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে এমন কয়েকটি ভিডিও লিংক শেয়ার করলাম।

০. এক রাজাকারের নিজস্ব কুকীর্তির সাফাই:



১. দরিদ্র রাজাকার আব্দুল কুদ্দুসের ইন্টারভিউ যে পাকিস্থান আর্মি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল রাজাকার হওয়ার জন্য:



২. যারা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী নিয়ে কাজ করছে তাদের সবার কাছে এ মুহুর্তে প্রচুর তথ্য প্রমানদি সংরক্ষিত আছে। এখন প্রস্তাবিত তদন্ত কমিটি এগুলো আইনের কাঠগড়ায় নিয়ে হাজির করবে। নিচের এই ভিডিও ফুটেজের প্রতাক্ষদর্শি'রা রাজাকার নিজামীর বিপক্ষে অনেক প্রমান দিতে পারছে:



3. An ex al-badr states their activities in sylhet during 1971, he takes the name of farid chowdry as the number one of al-badr in sylhet: ( as name of Farid chow) (Courtesy: Omi pial):



4. A Martyrs wife’s interview: Shyamoli Nasreen Chowdhury, wife of Dr. Alim Chowdhury gives her account how the Al Badar came and picked her husband. (Courtesy: Omi Pial):



5. Journalists and widows of martyrs tells their experience about al-badrs in 1971:



6. A school friend and close relative of Bangabandhu Sheikh Mujibur Raham recalls his experience of Golam Azam's role in Bangladesh Liberation War:



7. The interview of an collaborator in sylhet:


1. War Crime Evidence of MOTIUR RAHMAN NIZAMI -JAMAT LEADER -in Bangladesh1971

8. This is the first five minutes of the documentary. This video contains evidences of war crimes which took place in 1971 in the war between east pakistan (Bangladesh) and Pakistan:



9. Chowdry mueenuddin : profile of a killer, he was the most wanted killer right after the independce of Bangladesh. the operational in chief of al-badr (the killer wing of jamat-e islami) in Dhaka 1971 who operated the killings of the intellectuals:



10. Kusthia Hotta Kando documentary:



11. Eyewitness interview of liberation war in 1971:



12. A documentary: Few witness interviews:

http://www.youtube.com/watch?v=qgzLu6A9uiA&feature=related

13. Part 6 of 6 of Untold Stories of Liberation War of 1971 : Kamrul vi’s interview:



14. Bangladesh 1971 Victims: Roshon Ara:



15. Muktijoddhara -(1/3) Killings of Buddhijibees Dec 14,1971: witness Interview:

Part1:



Part2:



Part3:



মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের অনেক ঋন। জানি কখনই তা শোধ করা যাবে না। কিন্তু আমরা যেন অন্তত তাদের আত্মার উপহাসের পাত্র না হই।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

ছবিব্লগ: ইপ্পারওয়াস পার্ক

উচ্ছিষ্ট

বরুণার করুণ উচ্ছিষ্ট বুকের এলাকায়
করেছিলাম সুগন্ধী হৃদয়ের আঁচ,
তাতেই একপায়ে খাড়া ছিলাম
বলাকার মতো।
কিংবা- ওড়া ছাড়া
কীসের বলাকা,
কীসের কী?
বড়জোর বোকা
এক বক হয়ে ছিলাম ...
কদিন আগে ইপ্পারওয়াস পার্ক বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা কজন। সেখানে ছোট্ট একটা লেকের টলমলে পানি আমাদেরকে যারপর নাই মুগ্ধ করেছিল। সারাদিন পানিতে দাবাদাবি, ঘুরে বেড়ানো, কলা খাওয়া, সবকিছু নিয়ে ভালই কেটেছিল দিনটি। সেখানে কিছু ছবি তুলেছিলাম। তার কয়েকটি নিচে শেয়ার করলাম। ভালো লাগলে জানাবেন।

১.



২.



বন্ধন

বন্ধন ? বন্ধন বটে ,
সকলি বন্ধন,
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা ;
সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে
লইতেছে টানি,
নব নব রসস্রোতে
পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান ।
স্তন্যের পিপাসা ...

৩.



অবহেলা

ফুল কেন ছুঁড়ে ফেলে দাও
কেন বেদনা আবার খুলে দাও-
বসন্তে মল্লিকা বনছায়
কেন হেসে খেলে গেয়ে নেচে যাও
কেন বেদনা আবার খুলে দাও ।
চৈতের জোছনা সন্ধ্যাবেলা
দখিনা সমিরণ বয়ে যায়
উদাস নয়নে কারে খুঁজে চাও,
কেন বেদনা আবার খুলে দাও ।।

৪.



চাবি

আমার ঘরের চাবি পরেরই হাতে।
কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখবো চক্ষেতে।।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা পরে করে
লেনা দেনা আমি হলাম জন্ম-কানা
না পাই দেখিতে।।

৫.



অবকাশ

হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,
ছুটি নে কাহারো পিছুতে।
মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে।
নির্ভয়ে ধাই সুযোগ-কুযোগ বিছুরি,
খেয়াল-খবর রাখি নে তো
কোনো-কিছুরি-- উপরে চড়িতে যদি নাই পাই .

গলা আমার জড়িয়ে ধর ,
ঝাঁপিয়ে পড় কোলে ,
সেই তো আমার অসীম ছুটি প্রাণের তুফান তোলে ।
তোমার ছুটি কে যে জোগায় জানি নে তার রীত ,
আমার ছুটি তো জোগায় প্রকৃতি

৬.



পরজীবির আশ্রয়স্থল

পরজীবির মতো অসুখী ছায়া বুকে নিয়ে তোমার ছায়ায় হেঁটেছি অবিরাম
ক্ষয়িত ধূলি-ধুসর মেঠোপথ যতদূর গেছে.... তবু বিচ্ছেদ করেছে নিরাশ্রয়।
বল, ব্যথার এই সফেন বুকে নিয়ে আর কত ?
কতটা সময়, কতটা দিন ! আমার পাঁজরের পুস্পের কাছে
রেখেছি তোমায় সৌরভে ঘুমাবে অনাদীকাল জুড়ে।
দেখো, একদিন ঠিক তুমি অনুবাদ করতে পেরেছো এই ভীরু মৌনতা আমার
ক্ষয়িত যৌবনের দীর্ঘশ্বাস....
সেদিন আমি সব বন্দর ঘুরেফিরে না হয়
আবার নোঙ্গর ফেলবো তোমার বন্দরে !

৭.



সময়ের তৃষ্ঞা

সময়ের তৃষ্ঞা মেটে না,
মেটার নয়।
ভুলে ভুলে থাকা।
পালিয়ে।
জীবন হয়তো এমনই ...

৮.



উল্টো

খুব আপন বাতাস অচেনা গাঢ় নীল ফুল পুরনো ভালবাসা টুকটুকে সূর্য অবশেষে উল্টো আকাশ ... খুব সাধারণ এই মানুষটি কখনও কবি হতে চায়নি, সে অন্ততঃ একটি সত্যিকারের কবিতা লিখতে চেয়েছিল . ...

৯.



নীরবতা

যখন ঘুম নামে এই পাথুরে উপত্যকায় দিন রাতের বিভেদ ভুলে
প্রলম্বিত সুরে আরো দীর্ঘ করে সকল আলস্য
তখন চেতনারা শান্ত শিশুর মত চুপচাপ জেগে চোখ মেলে দেখে যায়
অসামঞ্জস্যে ভরপুর আমাদের বিদগ্ধ জগত।

সেপাই লাগাম ঝাকিয়ে ছুটছে ছুটিহীন সবুজের বুক চিরে অসময়ে,
আর সময় অপেক্ষায় দ্বিধাহীন কোনো মানুষের;
যে নিঃশংকোচে এগিয়ে যায় ভয়ার্ত আগামীর বুকে পদাঘাত এঁকে
এক আটলান্টিকের সাহসের বসবাস সেখানে।

১০.



লাল সবুজ

তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ।।
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে ।
তোমার ’পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে ।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ।।
ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–
তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা !
আমার জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে–
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা।।

--------------- অযুত শুভাশিষ সবাইকে।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

সোমবার, ১৭ মে, ২০১০

আমার দিনলিপি: "রুপসী ললনা" আর "বিজ্ঞান"

১৮ই মে, ২০১০: আজ একটা ওয়ার্কশপ ছিল। বিষয়: ন্যানোট্যাকনলজী ও তার এপ্লিকেশন। আয়োজনে ছিল কানাডার ওন্টারিও ন্যানোট্যাকনলজী রিচার্স ফোরাম। সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল একটা পোস্টার প্রদর্শন করা। যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, পোস্টার প্রেজেন্টশনের মধ্যে আহামরি কিচ্ছু নাই। পোস্টার প্রেজেন্টশন হল শুধু যার যার পোস্টারের সামনে "ভ্যাবলার" মত দাড়িয়ে থাকা। আর কেউ এসে “দুনিযার সব জানে” এমন ভয়াবহ-জ্ঞানীর ভাব নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর তাদের মনে কোনো খটকা লাগলে তাদের খটকাগুলো দুর করা। তো, মুল ব্যাপার এটা না, মুল কথা হল, বরাবরের মতই আমার আনন্দ কখনই পোস্টার দেখানোতে থাকে না, আমার আনন্দ থাকে পোস্টার ছাপিয়ে রুপবতী ললনাদের সাথে কথা বলার সুবর্ন সুযোগ পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু আজ পরিস্তিতি ভিন্ন। তিন ঘন্টার প্রেজেন্টশন এ দুই ঘন্টা চলে গেল, এখনও কোনো ললনা আমার পোস্টারের ধারে দিয়ে আসল না। ললনারা বামদিকের পোস্টারে আসে, ডানদিকে আসে। পেছনেরটাতে আসে, সামনের টাতেও আসে। আমারটাতে আসে না। বিরক্ত হয়ে আমার ঘনিষ্ট তুর্কি বন্ধু টমাসকে কিছু একটা করতে বললাম। সে বুদ্ধি দিল মেয়েরা আসতে দেখলে আশেপাশের বুড়া বুড়া প্রফেসরদের ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিবি, মেয়েরা বুড়া প্রফেসরদের পছন্দ করে না। তাদের ভয়ে হয়তো আসছে না। কথার সত্যতা পেলাম। আমার পোস্টারের সামনে বুড়াদের আনাগোনা। তার কথামত কাজ করতে লাগলাম। তাদেরকে ঠেলেঠুলে সরাতে লাগলাম। কিন্তু মামলা তা-ও তো খতরনাক।, পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম। হঠাৎ পরিস্থিতির আসন্ন উত্তরন দেখতে পেলাম। আমাদের প্রেজেন্টশেন শেষ হওয়ার মাত্র ৫ মিনিট আগে একজন চোখ-ঝলসানো সুন্দরী মেয়ে আমার পোস্টারের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে লাগল। মনে মনে বললাম এতক্ষনে বোধহয় উপরওয়ালা আমার পানে চোখ তুলে চেয়েছেন। যাক্, লাইফ মে কোচ্ সাদা হে। আমি তখন পোস্টারে প্রদর্শিত রিসার্চের সকল সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর মনে মনে সাজিয়ে নিতে লাগলাম। মেয়েটির প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুব ভালভাবে সাজিয়ে সুন্দর করে বলতে হবে। কোনো উত্তরই ল্যাজে-গোবরে করা যাবে না। কবি বলেছেন, “যদিবা অর্জিত করিতে হয় নারীমন, কথামালা সাজানো চাই অনন্য মধুক্ষন”। মেয়েটি যতই আমার কাছাকাছি আসতে লাগল আমার বুক ধড়ফড়ানি ততই বাড়তে লাগল। না জানি কি প্রশ্ন করে বসে! সাধারন গাধাটাইপ মানুষদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেখানে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর আসে, আর এ তো মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী ললনা। তো মেয়েটি একসময় আমার সান্নিধ্যে আসল, কাছে আসার পর ক্ষনিকের জন্য আমার পোস্টারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম আমার সাজানো কথামালাগুলো উদ্গরনের জন্য। এমন সময় মেয়েটি তার সুচিন্তিত প্রশ্নবাক্যটি ঝড়ো বেগে প্রকাশ করল। যা শুনে আমার ভ্রম্মতালু ছুয়ে বুঝতে পারলাম, চান্তি কিছুটা হলেও পুড়ে গেছে। মেয়েটি অসহায়ত্বের মত ভঙ্গি করে আমাকে যে প্রশ্নটি করেছেল সেটা হল: “Excuse me, could u tell me please where can I find the toilet?????, its emergency.”

পরিশিষ্ট: "কোথায় জানি পড়েছিলাম, সুন্দরী আর বিজ্ঞান সাথ সাথ যায় না।"
কথাটা মনে হয় একেবারে মিছা না! আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শনিবার, ৮ মে, ২০১০

মা

[আজ মায়ের সাথে অকারনে রাগ করলাম। অনেকটা ইচ্ছে করেই। আমার মা আমার থেকে হাজার মাইল দুরে। প্রতিদিন আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেন মা। না দিলে ধৈর্য্যহারা হয়ে নিজেই করে বসেন। মা, এত ভালবাসা কেন তোমার? এত কষ্ট দেই, তারপরও ভালবাসা ফুরায় না কেন তোমার? রাগারাগির পর খুব খারাপ লাগছিল আমার। সেটা কমাতেই এই আবেগী কবিতা। কবিতা হয়তো হয়নি, কিন্তু মায়েদের ভালবাসা এমন যে, তাদেরকে উপজিব্য করা কোন আবেগের বহিপ্রকাশ কোন ব্যর্থতাকে স্পর্শ করতে পারে না। সকল অপরিপক্কতা ছাপিয়ে ঠিকই উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় হয়ে উঠে সেই সত্তা তার নিজস্ব ভঙ্গিমায়। এটা লিখার সময় মাকে খুব অনুভব করেছিলাম, সেই ভাল লাগার অনুভুতিই প্রকাশ করলাম। প্লিজ খারাপ লাগলে গালি দিয়েন না, অন্তত]


মা,
সেই ছোট্টবেলায় প্রথম যেদিন
মিতালীপাড়ার স্কুলের আঙ্গিনার
পদধুলি দেবার কথা আমার,
তুমি মাথায় সিঁথি তুলে আশীষ দিয়েছিলে,
“বড় হও, বাবা, অনেক বড়,
মানুষ হিসেবে পূর্ন হয়”।
তোমার চোখে ছিল আমার জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, মা।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম
তোমার দিকে নিরিবিলি,
আমার দেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষটির দিকে।

মা,
মেঘেদের যুদ্ধে ছিল বৃষ্টিদের বিজয়ের দিন সেদিন।
তুমি ছাতা দিয়ে বলেছিলে, “সাথে রাখিস বাবা”
আমি নেইনি সেদিন, তোমার দেয়া।
হয়তো ভেবেছিলাম, তোমার মত এত বড়
ছাতা থাকতে কোন ঝড়ের ভয় মা?
কোন ঝড়ের ভয়?

ঠিকই অঝোড় ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন
নুড়িপাড়ার সাধনবাবুর দোকানে আটকা পড়েছিলাম,
অনেকক্ষন।
তুমি নিজে ভিজে চলে এসেছিলে আমাকে
অভেজা নিয়ে যেতে, মেঘেদের আড়াল করে।
খালি পায়ে।
আমার কয়েক ভেজা চুল তোমার আঁচল দিয়ে
মুছে দিতে দিতে মায়াভরা গলায় শাসন করেছিলে,
“আর কোনদিন ভিজবি না বৃষ্টিতে, ঠিক আছে?”
তোমার উষ্ঞ আচঁল দিয়ে আগলে ধরে রাখছিলে তুমি
আমায় কিছুক্ষন, গভীর মমতায়,
তোমার সিক্ত আশ্রয়ে।

মা,
পৌষের সংক্রান্তি ছিল ওইদিন।
ভোরের স্নান সেরে সোজা চুলার পাশে আমি।
তুমি পিঠা বানাচ্ছিলে,
কপালে তোমার বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বসে রইলাম তোমার দিকে চেয়ে মুগ্ধ নয়নে।
তুমি পাঠিসাপটা বানিয়ে দিতে লাগলে, অনবরত।
খাওয়া শেষে কম পড়েছিল বলে, তুমি
নিজে খাওনি সেদিন, বলেছিলে,
“তোরা খা, এতেই আমার তৃপ্তি”

মা,
জৌষ্ঠের নবান্নৎসবের ছুটি তখন,
দক্ষিনপাড়ার নবনীবাবুর কুয়োর ধার দিয়ে,
আসার সময়,
পড়ে জখম হয়েছিল খুব।
নিমপাতার রস লাগিয়ে দিয়েছিলে সেদিন,
উপরে কলাপাতার পট্টি, পরম যতনে।
তবু ক্ষতের নিস্তার নেই,
পায়ের জখম বিদ্রোহ করেছিল সেদিন রাত।
প্রবল জ্বরে কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম,
নকশীকাঁথায় ঢেকেও স্বস্তি নেই তোমার,
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঢেলে দিতে লাগলে
তোমার শরীরের ওম।
সারা রাত জেগে নির্ঘুম তুমি
মাখতে লাগলে জ্বল পট্টি, আমার তপ্ত কপালে,
পরম আদরে।
টলমল করছিল সেদিন
তোমার স্নেহঝড়ানো উদ্বিগ্নতার জ্বল।

মা,
আমার টিউশনির টাকা
একটু একটু করে জমিয়ে,
তোমাকে একটি নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম,
তোমার সেই শাড়ি গায়ে দিতে না তুমি
আলমারিতে যত্নে রাখ, সবসময়।
নষ্ট হয়ে যাবে বলে।

দেশের পড়া শেষে,
স্কলারশীপ নিয়ে হাজার মাইল দুরে আসার সময়,
আবেগি তুমি, কান্না থামিয়ে রাখতে পারছিলে না।
আচঁল দিয়ে চোখ লুকিয়ে রাখলে।
আসার বেলায়,
কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলে,
“ভাল থাকিস, বাবা”।
ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম আমি।

সেই তুমি আজ অনেকটাই জীর্ন।
রান্নাঘর থেকে সিংহদার,
এটুকুনই তোমার সকল ভাবনায়।
খুঁজে বেড়াও আমাদের, প্রতিটি মুহুর্ত।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার একটি ফোনের জন্য
অপেক্ষা করে বসে থাকো রিক্ত তুমি,
চাতকপাকির মত।
একদিন কথা না বললে
অস্থির হয়ে রাগ করে বসে থাকো,
অবোধ শিশুটির মত।

মা,
আচ্ছা আমি কি পারব, তোমার স্বপ্নটি পুরন করতে?
অনেক বড় হতে কথনও?
অথবা,
মানুষের পুর্নতা নিতে?
ভয় হয়, মা।
আমার।
একটু মাথায় তোমার আশীষের হাতটি বুলিয়ে দিবে, মা, ঠিক আগেটির মত।

আঁকা: নিজ, সাল: ২০০৩, পেন্সিল স্কেচ।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১০

গল্প: ভালবাসায় লোডশেডিং...........

গভীর রাত। ছাদের দক্ষিন কোনায় ছোট্ট ব্যালকনীর দেয়ালের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে আবীর। অজস্র তারা উঠেছে আজ। আবীর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের তারার দিকে। এ এক অদ্ভুত ভাল লাগা। তবে এক বিশেষ কারনে আবীরের মনে আজ অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি লোহিতকনিকা যেন তীব্র উত্তেজিত হয়ে রক্তনালিকা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যে মেয়েটার সাথে গত ছয়মাস ধরে ফেসবুকে/ফোনে চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে, সেই মেয়ের সাথে কালই প্রথম দেখা করতে যাচ্ছে আবীর। তারা গুলোর ফাঁক দিয়ে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। হিমেল বাতাসের আলতো ধাক্কা লাগছে আবীরের গায়ে। কিছু একটা ভাবতে যাচ্ছিল আবীর এমনসময় ফোনটা তার স্বভাবজাত স্বরে বেজে উঠল।
“কি করছ?”
“মাধবী”?
“হমম”।
“মাধবী জান, প্রবল আনন্দে আমার শরীর আজ কাঁপছে”।
“হুমম, এটাই স্বাভাবিক। আমার যে খুব ভয় ভয়ও করছে”!
“কেন”?
“তুমি যদি আমাকে দেখে পছন্দ না কর। আমি যদি তোমার মনের মত না হই”!
“এভাবে বল না, মাধবী। তোমাকে নিয়েই আমার সকল স্বপ্ন, আমার সকল ভাললাগা। এতদিন তিল তিল করে যে স্বপ্নের বাসর গড়েছি তোমাকে নিয়ে সে বাসর অবিনশ্বর, সেটা কি ভেঙ্গে ফেলা যায়? আমার সকল অস্বিত্ব, আমার সত্ত্বা তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়েই আমার পূর্ণতা।”
“এত ভালবাস আমাকে”?
“হুমম, এত। বিশ্বাস হয় না?”
“হুমম, হয়”।
“তুমি কাল কি পড়ে আসবে”?
“নীল টি-শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট”।
“আর আমি?”
“তুমি সবুজ শাড়ী পড়বে, মাথায় থাকবে রজনীগন্ধা, আর হাতে বেনারসি চুড়ি। ওকে?”
“ওকে, Done”।
“সোনা, একটু ছাদে উঠনা, প্লিজ। দেখনা কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। উঠনা একটু”।
“এই এখন না, এত রাতে ছাদে উঠলে বাবা সন্দেহ করবে”।
“প্লিজজজজজজজ”।
“ওহ, উঠছি বাবা। তুমি না, একটা পাগল”।
“হুমম, পাগল, সে তো তোমার জন্যই”।


অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলছিল আবীর মাধবীর সাথে। তাই ঘুম থেকে এত দেরি করে উঠা। এখন বাজে দুইটা। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে চুলে হালকা জেল দিয়ে গায়ে পারফিউম মাখিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবীর। সানগ্লাসটা হাতে নিল। মাধবীর পাঁচটার সময় শাহবাগের মোড়ে থাকার কথা। এখন বাজে তিনটা। প্রবল উত্তেজনা তাড়িত করছে আজ আবীরের মনে। অনিচ্ছাকৃতভাবে এত আগে বেরিয়ে পড়ার এটাই হয়তো কারন। “ফ্লোরা এন্ড ফাউনা” দোকান থেকে এক তোড়া লাল গোলাপ কিনল আবীর। হাটার ফাঁকে ফুলের সুবাস নিল। আহ। শাহবাগের মোড়ের কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে রইল আবীর। প্রতিক্ষার প্রতিটি মুহুর্ত যেন এক একটি বছর মনে হচ্ছে আবীরের কাছে আজ। কিছুক্ষন এদিক ওদিক হাটাহাটি কলল আবীর। মোড়ের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আকাশের অবস্থা ভাল না। কিছুক্ষের মধ্যে ঝড় নামবে।

অবশেষে এল সেই প্রতিক্ষিত মুহুর্ত। যে মুহুর্তটির জন্য মনের গহীনে ভালবাসা দিয়ে বুনেছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিক্ষার প্রহর। যার জন্য মনের অজান্তে অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিল আবীর। রাস্তার অপাশে রিকশাটি থামল। রিকশার হুড খুলে অল্প তাকাল মেয়েটি। সবুজ শাড়িতে ওকে একটি সবুজ পরীর মত লাগছে দেখতে। কপালে লাল টিপ। মাথায় রজনীগন্ধার ডালি। বিধাতা কি মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়েছিল এই নারীমূর্তি। আবীরের প্রবল উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল।
মাধবী হাত দিয়ে ইশারা করল, “এই, রিকশায় উঠো, ঝড় আসছে”।
কথা শুনে আবীর সম্বিত ফিরে পেল। আবীর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। ধেয়ে বৃষ্টি আসছে কিছুক্ষনের মধ্যেই।
আবীর তাড়াতাড়ি রিকশায় কাছাকাছি গেল।
“কেমন আছ, তুমি?”-মাধবী জানতে চাইল।
“হুমম, ভাল, তুমি?”
“খুব”।
“এখন রিকশায় উঠো, প্লিজ। বৃষ্টি আসছে এক্ষুনি”।
আবীর রিকশায় উঠল। আবীরের গা এই ঝড়ো বাতাসেও ঘামছে। এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সে কোন কথা খুজে পাচ্ছে না। তার গলা তোকায় জানি আটকে যাচ্ছে বারবার। মাধবীও কোন এক রহস্যজনক কারনে তার সহজাত কথার ফুলঝুরি হারিয়ে ফেলেছে আজ। যে মেয়েটি রাতের পর রাত, ঘন্টার পর ঘন্টা এই ছেলেটার সাথে কথা বলে যেত ক্লান্তিহীনভাবে, সেও আজ কোন বাক্য সাজাতে পারছে না বলার জন্য। আসার আগেও অনেক কথা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল দেখা হওয়ার পর বলবে বলে। এখন সব ভুলে গেছে। কিছুই আর মনে করতে পারছে না। অঝোড় ধারায় বৃষ্টি নামল। রিকশা থামাল ওরা। আবীর আঁচলচাঁপা দিয়ে মাধবীকে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে একটি আম গাছের নিচে গিয়ে দাড়াল। দুজনেই এখনও চুপচাপ। মাধবীই নীরবতা ভাঙ্গল প্রথম।
“এ্যাই, বৃষ্টিতে ভিজবে”?
“হুমম”
দুজনেই ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল তখন।
“কিছু বলছ না যে?”
“কি বলব”?
প্রশ্নটা করতে গিয়ে আবীর মাধবীর দিকে তাকাল। সবুজ শাড়িতে মাধবীর সারা শরীর লেপ্টে আছে বৃষ্টির পানিতে। কপালের লাল টিপটি অনেকটা সরে পড়েছে কপালের মধ্যস্থান থেকে। দেখতে কি অর্পুবই না লাগছে মেয়েটিকে। মানুষ এত অপরূপ সুন্দর হয় কি করে? একেই কি অসহ্য সুন্দর বলা হয়? যা দেখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ সরিয়ে ফেলতে হয়।
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ।
একটু পর আবীর ধরা গলায় বলল, “এ্যাই, তোমার হাতটা একটু ধরতে দিবে?”
মাধবী নীরবে এগিয়ে দিল তার হাতটি। মাধবীর হাতে হাত রাখল আবীর। এই কোমল ছোঁয়া আবীরের পুরো শরীরকে অদ্ভতভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। মাধবীর আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে আঙ্গল মিলিয়ে আবীর ওর সিক্ত হাতকে শক্ত করে ধরে থাকল। মাধবী আলতো করে আবীরের কাঁধে মাথা রাখল। দুজনেই দুর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আকাশের কালো মেঘ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে দিগন্ত সীমানায়।
মাধবী হঠাৎ তীব্র আবেগে বলে উঠল, “প্লিজ, কথা দাও, কখনও ছেড়ে যাবে না আমাকে? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না আবীর।”

“না, যাব না”। আবীর মাধবীর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মাধবীও তাই। দুজনের চোখে চোখ। মাধবীর গভীর ঘনকালো চোখ দুটো যেন আরও দূর্বল করে দিচ্ছিল আবীরকে।

আবীরের চোখে অশ্রু। স্বর্গীয় আনন্দের অশ্রু। বৃষ্টির পানির সাথে আবীরের অশ্রু মিশে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে না। আবীর মাধবীর ভেজা কপালে চুমু খেল। আবীর মনে মনে ভাবল, “এত সুখ কি তার কপালে সইবে”? আবীর এক হাত দিয়ে মাধবীর ভেজা শরীর তার শরীরের সাথে চেপে ধরল। দুজন মুখোমুখি। আবীর ধীরে ধীরে তার তপ্ত ঠোঁটটি মাধবীর রক্তিম ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নিতে থাকল। মাধবীর গরম নিশ্বাস স্পস্ট টের পাচ্ছে আবীর। দুটি শরীর, দুটি মন যেন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে ভালবাসার অন্তহীন গভীরতায়।

এক বছর পর।
“আবীর, তোমার মনে আছে? ঠিক এক বছর আগে, ঠিক এই এখানটায় আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। “
“মনে আছে”।
“আর আজ আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি ঠিক এখানটায় এসেই। আমাদের ভালবাসার চূড়ান্ত রূপ দিতে যাচ্ছি আজ”।
“হুমম, আবীর অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কিছুক্ষন পর বলল,
“ওইদিনের মত আজও তাই তোমাকে সবুজ শাড়ি পরে আসতে বলেছি, আর চুলে রজনীগন্ধা”।
মাধবী ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল, “তুমিও তাই”।
“হুমম”।
“এ্যাঁই, আজও আমার ওইদিনের মত খুব ভয় ভয় করছে”, মাধবী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
“কেন সোনা”?
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, বাবা ঠিকই আমাদের খুজে বের করে নিবে। কাল পালিয়ে আসার আগমুহুর্তে কেমন করে তাকাচ্ছিলেন বাবা। বাবা, আমার জন্য পারেন না, এমন কোন কাজ নেই আবীর। খুব ভয় করছে আমার, আবীর। এখানে যদি বাবা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আসেন। তোমাকে যদি ওরা কিছু করে ফেলে। তোমার যদি কিছু হয়, আমি বাঁচব না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে, আবীর”।
আবীর জড়িয়ে ধরল মাধবীকে, “ভেব না জান, কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে, ভরসা রাখ, লক্ষিটি”।

হঠাৎ ভোঁ ভোঁ করে কেঁদে উঠল মাধবী। আবীর আরও জড়িয়ে ধরল মাধবীকে। এমন সময় ভরাট স্বর শুনে চমকে উঠল মাধবী।
“তুই ই আমার মেয়েকে…..। এই ধর”।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে মাধবীর পিলে চমকে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। গলার স্বর আটকে যেতে থাকল। সামনে বাবা দাড়িয়ে। সাথে তার সসস্ত্র গুন্ডাদল।
আবীর করুন চোখে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আসন্ন পরিণতি মোকাবিলায় শক্তি অর্জনের চেষ্টা করতে লাগল আবীর মুহুর্তেই। মাধবী আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকল আবীরকে। মাধবীর বাবা এগিয়ে আসতে লাগল তীব্র বেগে তার সসস্ত্র বাহিনী নিয়ে।



[------ ধ্যাৎ, এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। শালার লোডশেডিং। বিদ্যুৎমন্ত্রির গোষ্টি গিলাই।

পুনশ্চ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রি, “ডিজিটাল বাংলাদেশ উইথ নো ইলেকট্রিসিটি” আমাদের দরকার নাই। প্লিজ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কিছু একটা ওয়ে বের করেন। আর কত! নাটক-ফাটক তো কিছুই দেখতে পারতেছি না। অন্তত ভালবাসায় লোডশেডিং কোনভাবেই মানা যায় না]
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০১০

কলেজ শেষের দিন (আজাইরা প্যাঁচাল)…….

আইজ আজাইরা প্যাঁচাল ছাড়া কিছু পাড়ুম না ঠিক কইচ্ছি। সো, গম্ভীর আর ভাববাদীরা এ পোস্ট মাড়াইয়েন না কইয়া দিলাম।

তখন ছিল কলেজ কাল। কলেজের নাম মুরারিচাদঁ কলেজ। কেমতে কেমতে কেটে গেল কলেজের দুই দুইটা বছর। টের পাইনি। সত্যই, মাঝি মাঝি ভাবি আর টাসকি খাই। আমার জীবনের সবচেয়ে মজাক সময় কেটেছে এই পাহাড় ঘেরা নয়নকাড়া কলেজটিতে। এই কলেজেরে চার বাইন্ডারির ভেতরেই আমার প্রখম নচিকেতা আর জেমসের ঝাকা-নাকা গানের সাথে মেশা। “লরেল জেল”এ মাখা চুল নিয়া আর ছয় প্যাকেট ওয়ালা জিন্সের ট্রাউজারে পাংকু কায়দায় পেছনের দুই প্যাকেটে হাত ঢুকিইয়া মাঞ্জা মেরে মেয়েদের সামনে দিয়া হেলেদুলে হাটাঁর ত তখন থেকেই শুরু। জীবনের প্রথম কোন রুপসী ললনার “এই উজবুক, রাস্তা মাপ” গালি শুনে টাসকি খাওয়া, প্রথম প্রেম, শেষ প্রেম, জেমস বন্ড সাবের মত সিগারেটে টান দিয়ে দিলদরিয়া হই যাওয়া, পাড়ার ভদ্র (!) পুলাপানগো লগে বইয়া নীল-লাল ছবি দেখা, এই রকম মেলা ঘটনার চাক্ষুস দাবীদার আমার এই কলেজ লাইফ।


মুই ছিলাম বেজায় ভালা (!) ছাত্র। দুই টার্ম ফাইনালের আগে নয়-নয় আঠার দিন আর দুই ইয়ার জেঞ্জের আগে চৌদ্দ-চৌদ্দ আঠাশ দিন, সর্বসাকুল্যে ছেছল্লিশ দিন ছাড়া বইয়ের ছায়ার ধার দিয়েও যেতাম না। কেউ এ নিয়ে টিটকারী মারলে সাথে সাথে রক্তিম চোখে রবীদা আর নিউটনের শিক্ষাজীবনীর দৃষ্টান্ত ঝাড়তাম। রবীদা আর নিউটন না, আমার চোখরাঙ্গানী দেইখা ওরা বলত, “ঠিকই তো, ছেছল্লিশ দিন তো মেলা দি, খাওয়া-দাওয়া কইরবেন নিয়মিত, স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাইখেন। পড়তে পড়তে তো কন্ঠনালী বের হয়ে পড়তাছে”।

সত্যই, ব্যাফক মজাকে মজাক দিন ছিল তখন। শুধু পরীক্ষা, থিসিস, প্রজেক্ট আর টার্ম ফাইনাল এইসব আজেবাজে, ফাউল জিনিসগুরো যদি না থাকত তাইলে লাইফটা আরো জোশ হইত। এইসব বিরক্তিকর জিনিসগুলো জ্বালাইয়া মারত সবসময়। এসবের জন্যি গন্ধরাজ নারিকেল তেল আর স্যান্ডেলিনা ডেইলি সোপের সৌজন্যে প্রচারিত “থ্রি স্ট্রুডিজ” টাও দেখতে পারতাম না নিয়মিত। আফসোস!

আমার কলেজ জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিল মাছুম স্যার। ভাল পড়ানোর জন্যি নয়, ক্লাসে অন্যদের থেকে আমাকে বেশি বেশি সমীহ করেন, সেটাও নয়, ক্লাসে এসে মজার মজার গল্প বলতেন, তাও নয়; উনি ক্লাসে পারসেন্টজ নেন না সেজন্য। আই লাভু স্যার, ইউ আর চো চুইট। অবশ্য পরীক্ষার দিন উনার বৈধ ছাত্র প্রমান দিতে শেষ পর্যন্ত আমাকে অবৈধ পথ নিতে হয়েছিল সেদিন। সে এক বিরাট ইতিহাস। আজ বলা যাবে না।

উড়া-ধোরা মতিলাল প্রফেসর। ডিজিটাল স্যার। ডিজিটাল ভাব (!) ছাড়া তো কথাই বলেন না। মেয়েদের যা বিশেষ পছন্দ ছিল। ক্লাসে পড়ানোর আগে মজার মজার গল্পও বলতেন, তাই ক্লাসে উপচে থাকত পড়া ভিড়। সামলানোই দায়। একদিন ভরা ক্লাসে স্যারের উড়া-ধোরা প্রশ্ন: “বলত, চন্দ্রশেখর জাহাজে বসে কিভাবে বিজ্ঞানী এডিংটনের সাথে যোগাযোগ রাখতেন?” সাথে সাথে ক্লাসের অন্যতম তুখোর ছাত্র তানভীরের ডিজিটাল উত্তর: “ইমেইলে স্যার”। পরে, স্যারের ডিজিটাল ঝাড়ি। “এত বেরেন লইয়া ঘুমাস কেমনে?”। মেয়েদের সামনে কঠিন ঝাড়ি খাইয়া তানভীর তো এক্কেবারে তব্দা। পরে এনালগি কায়দায় বেশি বেশি মার্ক দিয়া ডিজিটাল স্যার তার দিল-খুশ করাইছিলেন।

ফ্যাপড়া উত্তর দেয়া শুরু করেছিলাম সেকেন্ড ইয়ারের বায়োলজি প্র্যাকটিকেল ক্লাস থেকে। এক্সামিনার মাহবুব আখন্দ। প্রশ্ন দেইখা তো আমার মাথা ছানা-বাড়া। চোখে আন্ধার দেখতিয়াছি। কিছুই তো পারিনা। তাও নাছোড়বান্দা, উত্তর ছাড়া যাবে না। প্রশ্ন ছিল, উদ্ভিদের বিবর্তনবাদ ত্রিভুজাকার ছকের মাধ্যমে প্রদর্শন করে দেখাও। আর যাই কোথায়! সাথে সাথে কাঠপেন্সিল ভালভাবে সার্প করিয়া সুন্দর করে তিনটা ডান্ডি দিয়ে একটা ত্রিভুজ আকঁলাম আর মাঝখানে একটা হেইলা-দুইলা লতাগাছ একেঁ নিচে চিত্রের নাম দিলাম। “বিবর্তনবাদ: দুর্বাঘাস টু লাউগাছ”।

তখন চৈত্র মাস। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার চারদিন আগের রাত। সবে নতুন বই খুললাম। ঘষামাজা নাই। চকচকে ঝকঝকে সব পাতা। পরীক্ষা আসলে আমার এমনিতেই অসুখ-বিসুখ শুরু হইয়া যায়। তারমধ্যে পুরা একদিন কেমিস্ট্রি নিয়ে ডুবে থাকা ওইদিন। বুঝেন অবস্থা। ফলাফল: প্রচন্ড মাথা-ধরা। ধরা মানে যেই-সেই না, যদু-মধু না, একেবারে রাম ধরা। অতিপঠনে শইল তো অভ্যস্ত না! মানবে কেমতে বলেন? মা মধুমাখা মুখে সাজেশান দিলেন, “যা বাইরে থেকে একটু হেটে আয়, ভাল লাগবে”। মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য। পালন করতেই হবে। হাটার আগে তুমুল পড়োয়া ছাত্রের মত দশটা রাসায়নিক যৌগের নাম একটি ছোট্ট কাগজে লিখে জপতে জপতে যাচ্ছিলাম। সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেড, এইগুলান। বের হওয়ার আগে দাদু কয়েকটি বিদেশী সিনেমার লিস্টি দিয়েছিলেন। আসার সময় নিয়ে আসতে হবে, তিনি দেখবেন। ভিডিও মামাকে সিনেমার লিস্টি হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর বেটা কিছুক্ষন কঠিন মুখ করে তাকিয়ে এদিক-ওদিক দেখার পর বিরস মুখে বলল, “ভাই একটাও তো নাই, ছবিগুলা মনে হয় খুব লেটেস্ট”। দিলাম ঝাড়ি। “কি দোকান বসাইছেন মিয়া, এতগুলার মধ্যে একটাও থাকে না!” গৃহ প্রত্যাবর্তনের পর দাদুর টিটকারী, কিরে সিনেমার লিস্টিটা ফেলে গেলি যে? বুঝলাম, চৈত্রের গরম, বেরসের রসায়ন আর রসের মাথা-ধরা মিইল্লা আমার মাথা গেছে আউলাইয়া। আর আউলা মাথায় সিনেমার লিস্টি না দিয়ে দিলাম রাসায়নিক নামের লিস্টিটা। আর সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেড এর লিস্টিটা দেইখাই ভিডিও মামা বিরস মুখে বলেছিল “ছবিগুলা নির্ঘাৎ লেটেস্ট, তাই একটাও তাদের কালেকশনে নাই”।

আমার আরেকজন টপ ফেবারিট স্যার ছিল, হৃষি কেশ স্যার। বিশাল গিয়ানি নুক। পাগলা কিসিমের, মাথা পুরাই আউলা। জটিল জটিল সূত্র পড়ান শুধূ। “হাইজেনবার্গ ল ইন মেট্রিক্স ফর্ম”- উনার প্রিয় সূত্র। ফেবারিট হওয়ার হেতু হল, উনি পরীক্ষার খাতায় চোখ বুলান না। খাতায় সব প্রশ্নের বিপরীতে কিছু লিখা আছে কিনা সেটাই উনার কাছে বিবেচ্য বিষয়। কি লিখা আছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের সবার কাছে উনি তাই সিম্পলি জোশ স্যার। ফাইনাল পরীক্ষা। চারটি প্রশ্ন। তিনটি পারি, আরেকটা পারিনা। চিন্তা কি? তিন নম্বরটার উত্তরটাই চার নন্বরে আবার লিখলাম। রেজাল্ট? সেকেন্ড হাইঢেস্ট। মারহাবা।

এই ঘটনাটা আমাদের পপুলার পেসাব মকবুলকে (নিক নেম, ভয়ে আসল নাম মাড়াচ্ছি না) নিয়া (একবার এক স্যারের কঠিন ধমক খাওয়ার পর কে একজন তার প্যান্ট ভিজা দেখছিল, সেই থেকেই তার নাম পেসাব মকবুল)। প্রশ্নে বিশাল বড় একটা ঘটনার বিবরন দিয়ে শেষে ইংরাজিতে লিখা: “ড্র দি সিচুয়েশান হয়াট ইউ ওয়াচ..”। এই “ওয়াচ”-কে ঘড়ি আর “ড্র” মানে আঁকা ভেবে সে বড় করে একটা গোল্লা একেঁ চারদিক ঘুরিয়ে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত লিখে তিনটা বড় বড় কাটাঁ আঁকল। নিচে ক্যাপশন দিল “দেয়াল ঘড়ি”, ইংরাজিতে "Wall Watch"। সেই ঘড়িতে সে বর্তমান সময়টাও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে একেঁ দিয়ে আসছিল। তারপরও সে কেন এখানে কোন মার্ক পেল না, এটা তার কাছে এখনও রহস্য। ----এরকমই বিচিত্র চরিত্রের Peculiar ঘটনার সমাবেশে বিচিত্রময় সমারোহে সমৃদ্ধ এই কলেজ জীবন। আর না। অনেক হইছে।

অনেক আউল-ফাউল কথা ঝাড়লমি। সময় খাকলে মন্তবাইন, আর পারলে দু'তিনটা কথা শুনিয়ে যাইয়েন। ভালু থাকইন। অনেক অনেক শুকরিয়া।
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০১০

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৫ (শেষ পর্ব)

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-১
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-২
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৩
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৪
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৫
৫.
রতনীকান্ত একটি থলে থেকে গ্লাসভর্তি খেজুরের রস নিয়ে তাপস বাবুর দিকে এগিয়ে দিল। তাপস বাবু সেটা হাতে নিয়ে বললেন, “বাড়িটা অভিশপ্ত হওয়ার ঘটনাটা একটু খুলে বলবে?”
রতীকান্ত গলা খাকাড়ি দিয়ে বলা শুরু করল। “আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে এই বাড়িটা ছিল এলাকার প্রভাবশালী রায় পরিবারের। নাম রায়বাড়ি। তথাকথিত রাজা না হলেও এই এলাকার শাসনভার তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। প্রচুর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল তাদের। কথা বলার ফাকেঁ স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের দিকে তাকাতেই দেখি হলুদ ধোরা সাপটা পাশের ঘর থেকে বের হয়ে কিলবিল করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তখন রতীকান্ত হাত দিয়ে বিশেষ কায়দায় ইশারা করতেই সাপটা উল্টাদিকে গলে বেরিয়ে গেল। বুঝা গেল সাপটাকে পোষ মানিয়ে ফেলা হয়েছে।


রতীকান্ত আবার বলতে লাগল, তারা ছিল দুই ভাই, প্রতাপ রায় আর প্রদীপ রায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে সবসময় বিরোধ লেগেই থাকত। বয়োজৌষ্টতার হিসেবে প্রতাপ রায়ের উপর এলাকার শাসনভার বর্তায়। যা স্বার্থলোভী ছোটভাই প্রদীপ রায় কখনই মেনে নিতে পারেনি। সে অযোচিতভাবে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করতে চেয়েছিল সবসময়। একসময় রায়বাড়ির ঘর আলো করে আসল প্রতাপ রায়ের প্রথম পুত্রসন্তান সৌরভ রায়। রায় পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল তখন। তার দু’বছর পর এলাকায় কোন এক কারনে ভয়াবহ মহামারী দেখা দিল। ঘরে ঘরে অজানা এক রোগে মানুষ মারা যেতে লাগল। বাতাসের বেগে ছড়িয়ে যেতে লাগল এই মহামারী রোগটি। এক সাধুবাবা ওই বিশেষ সময়কে অভিশপ্ত হিসেবে ছড়াতে লাগলেন তখন। কিছুদিনের মধ্যে প্রতাপের প্রথম স্ত্রী আবারও সন্তানসম্ভবা। একদিন রাতে প্রতাপ রায় স্বপ্নে দেখলেন যে একটি কুয়ো কেটে কিছুক্ষনের জন্য তার আগত নবজাতককে কুয়োর নিচে শুয়ে রাখলে গ্রামের বর্তমান অভিশাপটি কেটে যাবে। গ্রামের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে স্ত্রীর অনেক আহাজারী উপেক্ষা করলেন প্রতাপ রায়। ফুটফুটে নবজাতক হওয়ার পরের দিনই কুয়ো কাটা হল কালীমন্দিরের ঝোপের পাশে। কুয়ো কাটার পর কোন এক রহস্যজনক কারনে পানি উঠছিল না কুয়োতে। তারপর নিষ্পাপ নবজাতককে নামানোর কিছুক্ষন পরই প্রবল বেগে পানি এসে উপছে পড়ল কুয়োটি। কুয়োর পানি এতই প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসতেছিল যে কোনভাবেই শিশুটিকে আর বাঁচানো গেল না। পরে শিশুটির নিথর দেহটি পানিতে ভেসে উঠল কুয়োর উপর। পরে স্বপ্নের আশিষটাই সত্যি হতে লাগল গ্রামে। গ্রামের মহামারীটি কালিমার কৃপায় দুর হতে লাগল ধীরে ধীরে। আর নতুন কোন মরার খবর আসল না। আবার ঘরে ঘরে মানুষ সুখে দিন কাটাতে লাগল। শুধু রায় পরিবারে রয়ে গেল তাদের সন্তান হারানোর অসহ্য যাতনা আর শুন্যতার দীর্ঘশ্বাস।

গ্রামের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রতাপ রায়ের সন্তানবিসর্জন গ্রামের মানুষদের কাছে প্রতাপ রায়ের গ্রহনযোগ্যতা আরো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সেই বাড়তি গ্রহনযোগ্যতা ছোট ভাই প্রদীপ রায়ের কাছে প্রবল ঈর্ষার কারন হয়ে দাড়াল। প্রদীপ রায় তখন ছলে বলে তার অবৈধ জিঘাংসা হাসিলের জন্য উঠে পড়ে লাগল। সে সুযোগ খুজতে লাগল যে কোন উপায়ে বড় ভাইকে ক্ষমতার সমনদ থেকে নামিয়ে দেওয়ার। দু:খজনকভাবে সুযোগও আসতে লাগল ধীরে ধীরে। একদিন প্রতাপের স্ত্রী কুয়োর ধারে বসে সৌরভকে স্নান করাচ্ছিলেন। ওত পেতে থাকা প্রদীপ বড় একটা শক্ত ঢিল ছুড়ে মারল প্রতাপের স্ত্রীর মাথার উপর। প্রচন্ড রক্তক্ষরন হতে লাগল সাথে সাথে। প্রদীপ কালক্ষেপন না করে প্রতাপের স্ত্রীর নিস্তেজ দেহটি কুয়োতে ফেলে দিয়ে রটালো কুয়োতে পরে মারা গিয়েছে প্রতাপের বৌ। সাত বছরের সৌরভ ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে দেখল সব। তারপর থেকে সৌরভের দেখাশোনার ভার বৃদ্ধ কেয়াটেকার মতিবাবুই নিল। সফল হয়ে প্রদীপ একই উপায়ে প্রতাপকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে লাগল তারপর। আর এদিকে বৌ-সন্তানকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল প্রতাপ রায়। অপ্রকৃতস্তের মত প্রলাপ বকত সবসময়। সেই অসহায় সানুষকেও বাচঁতে দিল না ছোটভাই নরলোভী প্রদীপ। একদিন সুযোগ বুঝে কুয়োয় ধারে কর্মরত প্রতাপকে পেছনদিক থেকে ঢিল মেরে কুযোতে ফেলে দিল প্রদীপ। আর মুহুর্তেই সে পেয়ে গেল রায় বংশের সব ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা পেয়েও সে থেমে ছিল না। রায় বংশের ভবিষ্যৎ মসনদ দাবীদার প্রতাপের বড় ছেলে সৌরভকেও মেরে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লাগল প্রদীপ রায়। পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে সৌরভের কেয়ারটেকার মতিবাবু সৌরভকে নিয়ে পালিয়ে গেল গ্রামের পাশের একটি নির্জন অরন্যে। সেখানে তিল তিল করে সৌরভকে বড় করতে লাগল মতিবাবু। কিন্তু সেই গহীন অরণ্যেও সৌবল রেহাই পেল না হিংস্র প্রদীপের দুষ্ট নখর থেকে। বছর কয়েক পর প্রদীপ ঠিকই খুজে বের করে নিল সৌরভকে। তাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে কুয়োর পানিতে ফেলে দিল সে।
তারপর কয়েকবছর প্রদীপ রায় গ্রামের নিরীহ মানুষদের উপর শাসনের নামে নীপিড়ন, অমানুষিক অত্যাচার চালাতে লাগল। এভাবেই এক সময় রায়বাড়ি অভিশপ্ত বাড়ি হয়ে উঠল সবার কাছে। একসময় গ্রামের মানুষ ধৈর্য্যহারা হয়ে ক্ষেপে উঠল। এক হয়ে লড়াই করে গ্রামছাড়া করল রায় পরিবারের সবাইকে। তারপরে আমার দাদা বৃদ্ধ কেয়ারটেকার মতিবাবুকে বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব দিল তারা। এভাবেই সমাপ্তি হল এই রায় বাড়ির ঘৃন্য ইতিহাস একসময়।
লোকটি থামলে হতভম্বের মত কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন তাপস বাবু এই পুরো বাড়িটির দিকে। এই বাড়িতেই দেড়শ বছর আগে এতগুলো খুন হয়ে গেল। তিনি কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল তাপস বাবুর।

খেজুরের রসে শেষ চুমুক দিয়ে তাপস বাবু রতীকান্তকে জিজ্ঞেস করলেন্, “শুভ্রদের বাড়িটা কোনদিকে? সে একটু যেতে চায় তার বাড়ি”।
“কোন শুভ্র? শুভ্র রায়?” পাল্টা প্রশ্ন করল রতীকান্ত।
তাপস বাবু বললেন, “হুমম”।
রতীকান্ত বলল, “সেইতো সৌরভ রায়, প্রতাপ রায়ের বড় ছেলে যাকে প্রদীপ রায় সবার শেষে নৃশংসভাবে হত্যা করল। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা ছিল বলে দাদীমা “শুভ্র” নাম রেখেছিল।”
হয়তো প্রশ্ন ঠিকমতো বুঝতে পারে নাই ভেবে তাপস বাবু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রতীকান্ত বলতে লাগল, “ছেলেটার বাম গালে ছিল একটি আকাঁবাকাঁ কাটা দাগ। ছোটবেলা বড় একটা ধার কাঠের মূর্তিতে উপর পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিল এর কচি গাল। এই কাটা দাগে অনিন্দ্যসুন্দর সৌরভকে আরও সুন্দর লাগত বলে সবাই বলাবলি করত। মারা যাওয়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত সে সবসময় একটি মাঝারি কালো পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াত। একমাত্র সেই তার পিতামাতার হত্যার নীরব সাক্ষী ছিল। তাদের দুজনকেই পাথরের ঢিল ছুড়ে মারা হয়েছিল। তাই হয়তো সে পাথর সাথে রাখত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

মুহুর্তে তাপস বাবুর গা কাপঁতে লাগল। এত বড় বিস্ময়সাগরে বোধ হয় আর পরেননি কখনও তাপস বাবু। তাহলে কি শুভ্র……? গলার স্বর আটকে যেতে লাগল তাপস বাবুর। কেয়ারটেকার আরও কি কি বলছিল, কিছুই আর কানে ঢুকছে না তাপস বাবুর। একটি অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল তখন। রতীকান্ত নিজেই বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিল। ফেরার আগে অভিশপ্ত বাড়িটির দিকে আবার তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন কিছুক্ষনের জন্য। বাড়ির পেছনদিকটার ঘরে কালো ধোরাটিকে কিলবিলিয়ে আবার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলেন।
রতীকান্ত পরে এই সন্ধ্যায় নিজে তাপস বাবুকে বাড়ি পৌছে দিলেন আর যাবার সময় একবার তার বাড়িতে পদধুলি দেওয়ার জন্য নেমন্তনও দিয়ে গেলেন।

তাপস বাবু বাসায় এসেও একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেন। মাথায় শুধূ শুভ্রর বলা কথাগুলো একে একে ঘোরপাক খাচ্ছে। আজ পূর্ণিমা। আজ শুভ্রর আসার কথা। তিনি টেবিলের ধারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন শুভ্রর জন্য। জানালা দিয়ে প্রবল বাতাস আসছে। শ্রাবন মাস। বৃষ্টি-বাদলের মাস। তবু এবার ঝড়-ঝাপ্টা একটু বেশিই অনুভুত মনে হচ্ছে। বাতাসের প্রবল ঝাপটায় জানালার ডালা বার বার ধাক্কা খাচ্ছে পাশের দেয়ালটিতে। শুভ্র আসতে পারে ভেবে জানালাও বন্ধ করছেন না তাপস বাবু। তাপস বাবুর মনে পড়ল শুভ্র আজ তার জন্য একটি উপহার নিয়ে আসবে বলেছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন বড় থালার মত বড় চাদঁ উঠেছে আজ। চাদেঁর ম্লান আলোয় চারিদিকে কেমন গা ছমছম করা ভুতুরে পরিবেশ। অনেক রাত হয়ে গেল। না, শুভ্র আসেনি। মনে পড়ল শুভ্রর একটি কথা: “আমি কারো অতি আগ্রহে দেখা দেই না”। তাহলে কি সে আর আসবে না আর। এইরকম চিন্তা করতে করতেই তাপস বাবু একসময় গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।

ঘুম ভাঙ্গল পরিমলের প্রবল দরজা ধাক্কানিতে। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলেন তাপস বাবু। দরজা খুলামাত্রই পরিমল তাপস বাবুর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। বাবু, আপনি আমার বড় উপকার করলেন, বাবু। চেয়ারম্যন সাব কাল সন্ধেবেলা আমাকে ডেকে নিয়ে আমার বন্ধকী বাড়িটি ফিরিয়ে দিয়েছেন গো, বাবু। আপনি আমার বড় উপকার করলেন গো, বাবু।

অনেক কষ্টে বিগলিত তাপস বাবু পরিমলের হাতখানা ছাড়িয়ে আনলেন নিজের পা-যুগল থেকে। সকালের প্রাত্যাহিক কাজ সেরে জানালার ধারে টেবিলের দিকে তাকাতেই তাপস বাবুর গা মোচর দিয়ে উঠল। গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। টেবিলের উপর একটি মাঝারি কালো পাথর রাখা। তাহলে কি কাল গভীর রাতে এসেছিল শুভ্র। এটাই কি তার সেই উপহার? এটাই কি সে মারা যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াত তার পিতা-মাতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তাপস বাবুর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তাহলে কি শুভ্র তার অতৃপ্ত প্রতিশোধের ভার তার উপর দিতে চাচ্ছে নিজে ব্যর্থ হয়ে? তার অতৃপ্ত আত্মা কি তার নিজস্ব প্রতিশোধের জ্বালা আরেকজনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে? যাতে করে সেই প্রতিশোধের জ্বালা জিইয়ে রাখা যায় যুগ থেকে যুগান্তরে। কিন্তু, এ কি করে সম্ভব? কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না তাপস বাবু। সবকিছু খুব এলোমেলো লাগছে তাপস বাবুর কাছে। কিছুই গুছিয়ে ভাবতে পারছেন না তাপস বাবু।

তারপর অনেক রাত অবধি জেগে থাকলেন শুভ্রর অপেক্ষায়। কিন্তু আর কোনদিন আসেনি শুভ্র। হয়তো আর কখনও আসবেও না।

ফিরে যাবার সময় চলে এসেছে তাপস বাবুর। আজই চলে যাবেন। পরিমল অনেক পিঠাপুলি ভরা একটি থলে ধরিয়ে দিলেন তাপস বাবুর হাতে। সেগুলো নিয়েই বের হলেন তাপস বাবু্। যাবার আগে কুয়োতে শুভ্রর দেওয়া পাথরটি ফেলে দিয়ে গেলেন। এবং কুয়োর গভীর টলটলে পানির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষন। মনে মনে বললেন, শুভ্র, ক্ষমা কর, পারলাম না তোমার অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করতে, আমি অপারগ। সেটা যে আমার ক্ষমতার বাইরে।
আসার আগে শেষবারের মত আবারও তাকিয়ে দেখলেন বাড়িটা কিছুক্ষনের জন্য। এখনও কি সুন্দর ঠাঁয় দাড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত অভিশপ্ত এই বাড়িটা। হয়তো বয়সের চাপাকলে আরও কয়েক বছর পর সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কোন অবশিষ্টই হয়তো থাকবে না। শুধূ পড়ে থাকবে কুয়োর টলটলে পানির মধ্যে মিশানো একটি অতৃপ্ত আত্মার অতৃপ্ত প্রতিশোধের প্রবল তৃষ্ঞা।

পরিশিষ্ট: এর একবছর পর তাপস বাবু শুভ্রকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখলেন। নাম দিলেন: “প্রতিশোধের পাথর”। তাপস বাবু জানতেন, শুভ্রর চাপিয়ে দেওয়া দয়িত্ববার বহন করার ক্ষমতা হয়তো তার নাই। তাই নিজেকে অপরাধীও ভাবতে লাগছিলেন তাপস বাবু। কিন্তু এটাও জানতেন শুভ্র তার অতৃপ্ত প্রতিশোধকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সামর্থ্যবানদের উপর। তাপস বাবু সামর্থ্যহীন হয়ে নিজে ব্যর্থ হলেও গল্পের মাধ্যমে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষীন চেষ্টাতো করলেন। এতেও যদি কিছুটা তৃপ্তি পাওয়া যায় একটি অতৃপ্ত আত্মার অর্পিত দায়িত্ব পালনের।

(শেষ)
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৪

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-১
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-২
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৩
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৪
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৫
৪.
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। যেই-সেই বৃষ্টি না, উথাল-পাতাল বৃষ্টি। একবার দক্ষিন পাশ থেকে ঝাপটা আসছে তো একবার উত্তর দিক থেকে। সাথে পাগলা-টাইপ বাতাস। এমন বৃষ্টি দেখেই বোধহয় কবিগুরু গেয়ে উঠেছিলেন, “পাগলা হাওয়া, বাদল দিনে….”। বড় মাপের কবি-সাহিত্যিকদের সবকিছুতেই আনন্দ যা সাধারনের মধ্যে থাকে না। আর সকল আনন্দই তারা অমর করে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেন তাদের শিল্পের মধ্য দিয়ে। সাধারনরা যা তৈরি করতে না পারলেও উপভোগ করতে পারেন। আর উপভোগের সফল গ্রহনযোগ্যতার মধ্য দিয়েই শিল্পেরসৃষ্টির মুল সার্থকথা। ঘুম থেকে উঠে এখনও বিছানায় শুয়ে আছেন তাপস বাবু। জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছেন একমনে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। জানালার ধারেই একটা বড় নারকেল গাছ। গাছের পাতাগুলো ঝড়ের ঝাপটায় লেপটে গেছে। গাছের ফাকঁ দিয়ে গ্রামের সরু মেঠো পথটি দেখা যাচ্ছে। শুভ্র বলেছিল এই রাস্তা দিয়েই তাদের বাড়ি যেতে হয়। তাপস বাবু ঠিক করেছিলেন আজ ওর বাড়ি যাবেন একবার। কিন্তু আকাশের এই রৌদ্রমূর্তিতে যাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। পরে তাপস বাবু সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন আজকের জন্য।


পরদিন তাপস বাবু অনেক বেলা করে ঘর খেকে বের হলেন। কাল অনেক ঝড়ের পর আজ আকাশ ঝকঝকে। প্রকৃতির শক্তি ক্ষয়ের পর আজ থেকে আবার নতুন করে শক্তি অর্জনের চেষ্টা। মেঠো পথ, কাদাময়। ঝড়ের কারনে পিচ্ছিলও। হাটতে বেজায় কষ্টই হচ্ছে। শুধু শুভ্রর বাড়ি না আজ পুরো গ্রামটাও ঘুরে ঘুরে দেখবেন বলে ভেবে রেখেছেন। শুভ্রর দেওয়া কথামতই এগুতে লাগলেন ধীরে ধীরে তাপস বাবু। একটি যুবককে এই পথ ধরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন পথটি সম্পর্কে। লোকটি হা করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। তারপর জবাব না দিয়েই চলে গেল। কি ভেবেছে কে জানে! পরে একজন বয়োবৃদ্ধকে আসতে দেখে আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন তাপস বাবু। প্রশ্ন শুনে লোকটির চেহারা পাল্টে গেল অনেকটা। কথা না বলে হাত ইশারা করে দেখিয়ে দিয়ে চুপচাপ আবার তার পথে হাটা শুরু করল। তাপস বাবু সবার এই নীরবতার কোন কারন খুজে পেলেন না। উটকো আগন্তুক দেখে হয়তো অস্বস্তি লাগছে তাদের কাছে। যতই এগুচ্ছেন ততই জঙ্লামত জায়গার ভেতর দিয়ে ঢুকছেন। আরও খানিকটা ঢুকার পর চারপাশে আর কোন লোকালয় দেখতে পেলেন না তাপস বাবু। ফলে আর বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি পথ হারিয়েছেন। এমন কাউকে আর পাচ্ছেনও না যাকে অনুরোধ করবেন দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তবুও সামনে এগুতে লাগলেন্ হাটতে হাটতে একসময় অজস্র ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা একটা গহীন অরন্যে চলে এলেন। সামনে প্রচুর লতা-পাতায় ঘেরা একটি বহু পুরনো, পরিত্যক্ত রাজবাড়ির ধ্বংসাবেশ দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা কংক্রিটের পাকা। পেছনের কিছু অংশ চালা দিয়ে ঘেরা। ভেতরে কেই থাকে বলে বলে মনে হচ্ছে না। বাড়িটা প্রাসাদতুল্য। পুরাকীর্তির অঢেল ছাপ পাওয়া যাচ্ছে এর প্রতিটা দেওয়ালে। অনেক পরিশ্রমসাধ্য, শৈল্পিক কারুকার্যের নিদর্শন রয়েছে সকল ঘরের দেওয়ালে। বুঝা যাচ্ছে, এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা রাজকীয় জীবন-যাপন করতেন। বাড়ির চারদিকে কেমন গা ছমছম শুনশান নীরবতা। এলাকাটা আসলেই একেবারেই জনমানবশুন্য। বাড়ির মধ্যঘরটা জলসা ঘরের মত। চারপাশটা দুতলার বারান্দা ঘেরা। বারান্দার রেলিংগুলো বেশিরভাগই ভেংঙ্গে পড়েছে কালের ভারে। জলসা ঘরের বামপাশের দেয়ালজুড়ে বড় একটি পেইন্টিং আকাঁ। অনেক জায়গার রং শক্ত হয়ে আস্তরের মত ঝুলে আছে। পেইন্টিংয়ের চারপাশটা শ্যাঁওলা ধরে অস্পস্ট হয়ে গিয়েছে বলেই হয়তো এখনও কারো সংগ্রহদৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ছবিটির উপজিব্য হল দুটি দেবশিশু একটি সৃর্যদেবতার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। একটি দেবশিশুর বাম গালে একটি গাঢ় কালো তিল। তার এক হাতে একটি ছোট পাথর। যে পাথরটি সে সূর্যদেবতার হাতে দেওয়ার ভঙ্গি নিয়ে আছে। ছবিটির বেশিরভাগ অংশই খসে পড়েছে।
চারদিকে অজস্র ধুলির আস্তরন আর মাকড়শার জাল দেখে বুজাই যাচ্ছে এদিকটায় কোন জনমানবের আনাগোনা নেই।

জলসা ঘরটা পেরিয়ে পাশের ছোট ঘরটায় উকি দিতেই গা শিরশিরিয়ে উঠল তাপস বাবুর। একটা বড় হলুদ ধোরা সাপ তার থলথলে গা পেঁচিয়ে শুয়ে আছে ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে একটা কোনায়। তাপস বাবু ভয়ে লাফিয়ে ঘরটি থেকে বের হলেন। ঘর থেকে বের হয়ে কিছুদুর এগুতেই একটি কালীমূর্তির ঘর দেখতে পেলেন। তার ধারটাতেই একটি পরিত্যক্ত বড় গহীন কুয়ো। কুয়োর কাছে গিয়ে নিচ দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলেন তাপস বাবু। পানি অনেক গভীরে। ভেতরে সুর্য়ের আলোও ঢুকছে না ঠিকমতো। কুয়োর কংক্রিটের অংশগুলো ঝোপ-ঝাড়ে ঠেসা। কুয়ো থেকে পেছ ফিরে তাকাতেই তাপস বাবু হঠাৎ দেখলেন একটি বৃদ্ধলোক তার দিকে শ্যোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচমকা দেখে তাপস বাবুর হৃদপিন্ড কেঁপে উঠল। লোকটির চোখ-মুখ কঠিন, গায়ে ময়লা কাপড়, হাতে একটি পুটলি।
কথা বলে বুঝা গেল লোকটি এই পরিত্যক্ত বাড়ির কেয়ারটেকার। কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তাপস বাবুকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কি জন্য এসেছেন?”
প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে লোকটি ইশারা করে তার সাথে হাটতে বলল। পরে সে পথ দেখিয়ে আবার তাপস বাবুকে জলসা ঘরটায় নিয়ে গেল।
“আপনি কি পুরাতত্নবিদ টাইপের কেউ?”-লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“না। টুকটাক লেখালেখি করি। এখানে গ্রাম দেখতে দেখতেই ঢুকে পড়েছি”।
লোকটি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল-“আর অমনি অভিশপ্ত বাড়ি চষে বেড়াতে লাগলেন?”
রহস্য আছে বুঝতে পেরে তাপস বাবু মনোযোগী শ্রোতা হয়ে কেযারটেকারকে খুলে বলার জন্য পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগলেন।
“খেজুরের রস খাবেন?:-লোকটি জানতে চাইল।
“এখানে খেজুরের রস পাওয়া যায়?”-তাপস বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি থাকি এখান থেকে দশ ক্রোশ দুরে একটি কুঠিঘরে। মাঝে মাঝে এখানে এসে বাড়িটা একটু দেখে যাই। হাটার ক্লান্তি দুর করার জন্য খেজুরের রস সাথে করে নিয়ে আসি সবসময়। খেজুরের রস ক্লান্তি দুর করার জন্য ভাল মহৌষোধ। আজ আসার কথা ছিল না। কিন্তু পথে একজন আপনি এদিকটায় আসছেন বলায় আমি আসতে বাধ্য হলাম এখানে। আমার আসল নাম রতীকান্ত। আমার দাদা এ বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন। বংশপরস্পরায় এখন আমিও”।

(চলবে)
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৩

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-১
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-২
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৩
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৪
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৫
৩.
রাতের খাবার শেষ করে টেবিলে বসে কেন জানি মনে হল আজ রাতে ছেলেটা হয়তো আসবে। তাই জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকলেন কিছুক্ষন তাপস বাবু। কিন্তু না, সে আসেনি। বিরস মুখে টেবিল ছেড়ে বিছানায় দিকে যাওয়ার সময় জানালার কপাটের শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই দেখলেন, শুভ্র ছেলেটা দাড়িয়ে আছে জানালার রড শক্ত করে ধরে। ছেলেটা কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর কথা বলা শুরু করল।
“আপনি যে গল্পটা মনে মনে সাজাচ্ছেন প্যারানরমাল বিবেচনা করে, সেটা কোনভাবেই এই ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না।”


তাপস বাবু খানিক বিস্মিত হয়ে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মনে মনে এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারন বের করতে দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি গল্পের বিষয়টি নিয়ে কাল বিকেলে গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক হানিফ মিয়ার সাথে অনেকক্ষন কথাচ্ছলে বলেছিলেন। তার এই শিক্ষকের ছাত্র হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এত ডিটেল নিয়ে ত আলাপ করেননি ওই শিক্ষকের সাথে। তাহলে কি সে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কারো অন্যের মস্তিস্কে ঢুকার ক্ষমতা রাখে। এ ধরনের অনেক উদাহরন আছে শুনেছি। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার ডেভিড শিফিল্ড নামের এক লোক এভাবে কয়েকজন ব্যক্তির মস্তিস্কে ঢুকে তাদের চিন্তার হুবুহু বর্ননা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল একবার। তাকে নিয়ে অনেক গবেষনাও করা হয়েছিল। গবেষকরা টেলিপ্যাথির ব্যাখ্যা দেখানো ছাড়া আর কোন বিশ্বাসযোগ্য কারন দেখাতে পারেন নি অবশ্য।
তাপস বাবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কিভাবে বুঝলে প্যারানরমাল বলা উচিত না?”
সে জানালার রড আরো শক্ত করে ধরে বলতে লাগল, “কারন, সেইসব ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যতীত বলা হয়, যেগুলো বর্তমান সময় তার রহস্যের নির্ভরযোগ্য কোন সমাধান দেখানোর ক্ষমতা রাখে না। যা অবশ্যম্ভাবীভাবে ভবিষ্যৎ কোন সময় ঠিকই বের করে নিবে।, তাই এখানে সময়ের আপেক্ষিকতাই এধরনের তুলনামূলক ধারনার পরিবর্তন ঘটানোর নিমিত্ত। আর কোন চলতি গবেষনা চলাকালীন সময় পর্যন্ত তাকে অলৌকিক আখ্যা দেওয়া স্বভাবতই অনুচিত বিবেচনা হওয়া উচিত”।

ছেলেটার গভীর চিন্তাশক্তি আর প্রখর কথাশৈলী তাপস বাবুকে প্রবল বিস্মিত আর কৌতহলী করে তুলল। ছেলেটার বাহ্যিক বয়সের সাথে তার চিন্তাশক্তি কোনভাবেই যায় না। তাপস বাবু অনেক চেষ্টা করেও এর পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারলেন না।

তাপস বাবু প্রবল আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলেন, “কি নাম তোমার?”
“শুভ্র”।
“তাপস বাবু বললেন, কাল বৃষ্টি ছিল, তোমার শরীর ভেজা ছিল, আজ তো বৃষ্টি নেই, তারপরও তুমি কাকভেজা কেন?”
“কুয়োতে স্নান করে এসেছি, তাই। “
“প্রতিদিনই কি তুমি এমন সময় কুয়োতে স্নান করতে যাও?”
“না, প্রতিদিন না, পূর্ণিমার শেষ তিনরাত যাই। তখন কুয়োতে জোয়ারের জন্য পানি ফুলে ওঠে। পানি হাতের নাগালে পাওয়া যায়”।
“শুধু পূর্ণিমার তিন রাত কেন?”
“ওই তিনরাতই শুধু হাতের পানি নাগালের মধ্যে থাকে। এখন যাই আমি”। বলেই সে জবাবের অপেক্ষা না করে নিমিষে হাওয়া হয়ে গেল। তাপস বাবু কয়েকবার ডাকলেন তাকে। কিন্তু কোন লাভ হল না। তাপস বাবু ক্রমশ কৌতুহলী হয়ে উঠছেন ছেলেটি নিয়ে।

পরদিন দুপুরে চেয়ারম্যান খোজ-খবর নিতে আসলেন হাতে দুই জোড়া ডাব নিয়ে। সাগরেদের হাতে একটি খাসি ধরা।
“বাবু, সময়ের অভাবে খাতির-যত্ন করতে পারছি না ঠিকমতো। কই রে, পরিমল, ডাবগুলো ধর, আর খাসিটা জবাই দে। আজ আমার মনটা বেজায় খুশ, বাবু। আমার প্রথম বউটা পোয়াতি, আজই ডাক্তার জানাল। আপনার আর কিছু কি লাগবে বাবু। একটা কিছু চান। আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ, বাবু। আমার কাছে আপনার চাওয়ার হয়তো কিছু থাকবে না। তারপরও অধমের খুব ইচ্ছে আপনাকে একটা কিছু দেওয়ার”।
তাপস বাবু সুযোগটি কাজে লাগালেন। এটা অত্যন্ত খুশির খবর। হ্যাঁ, আমার কিছু চাওয়ার আছে। দিবেন আশা করি।
“বলেন বাবু, সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যিই দিব”-চেয়ারম্যান বললেন।
আপনি পরিমলের বন্ধকী জমিটি তাকে আবার ফিরিয়ে দিবেন, আপনার পাওনা তো সে ইতিমধ্যে মিটিয়ে দিয়েছে। তার পাওনা-টাও আপনার মিটিয়ে দিন।
চেয়ারম্যান কথাগুলো শুনে থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন। কিছুক্ষন অন্যমনস্কভাবে কিছু ভেবে ডাবগুলো নামাতে নামাতে বললেন, “এসব কি বলছেন বাবু, এর বন্ধকী জমি তো আমি এমনিতেই ফিরিয়ে দিতাম। আমি বাবু, কালই আমার নিজের গাড়ি দিয়ে তাকে তার ভিঠেতে উঠিয়ে দিয়ে আসব। কই গেলি রে, পরিমল, “ডাবগুলো ধর”।

আজ রাতে শুভ্র আবার আসল। তার চোখ টকটকে লাল। তাপস বাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?” সে বলল, “আমার কাকাকে খুজছি, তার উপর অনেক ক্ষোভ”
“কেন? তোমাকে বকেছেন বুঝি?”-তাপস বাবু বললেন।
“হুমম। আপনাকে একটি জিনিস দিতে চাই আমি, নেবেন?”
“কি জিনিস?”
“আছে, আমি নিয়ে আসব একদিন”।
বলেই সে নিমিষে মিলিয়ে গেল।
তার পর আরও কয়েকদিন এসেছিল শুভ্র। অনেক কথা হত। বাড়িতে যাবার জন্য বলে দিল। তাপস বাবুর নিজেরও খুব আগ্রহ একদিন ওর বাড়িতে যাওয়ার। তাপস বাবু ঠিক করে নিলেন, গল্প লেখাটা গুছিয়ে নিলেই যাবেন একদিন। গ্রামটাও এখনও দেখা হয়নি ভাল করে।

(চলবে)
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......

শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০১০

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-২

অতৃপ্ত প্রতিশোধ-১
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-২
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৩
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৪
অতৃপ্ত প্রতিশোধ-৫
২.
জানালার বাইরে থেকে সুতীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি তাপস বাবুর চোখের দিকে। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। এ ধরনের ফর্সা ছেলে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না গ্রামে-গঞ্জে। একটি ১২/১৩ বছরের ছেলের চোখের যেরকম দীপ্তি থাকার কথা তার চোখে-মুখে এর থেকে বেশিই আছে। সেই দীপ্তিময় দৃষ্টি যে কারো পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ছেলেটির অস্বাভাবিক দৃষ্টি তাপস বাবুকে প্রবল কৌতুহলী করে তুলল। মুখের বাম দিকটায় একটি বড় কাটা দাগ আছে ছেলেটার। দাগটা অনেকটাই আকাঁবাকাঁ। হয়তো বয়সিক দুষ্টুমির কোন চাপ। বৃষ্টির কারনে শরীর পুরো ভেজা। দাগটির ক্ষত দিয়ে বৃষ্টির পানি থেকে থেকে পড়ছে।

কিছু বলবে তুমি?-তাপস বাবু কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। প্রশ্ন শোনামাত্র ছেলেটি আর বিলম্ব করল না, চোখের নিমিষে পালিয়ে গেল। তাপস বাবু কৌতুহল দমন করার চেষ্টা করলেন্। সম্ভাব্য উত্তরগুলো মনের মত সাজিয়ে নিলেন। হয়তো গ্রামের কোন সম্ভান্ত পরিবারের কোন ছেলে বৃষ্টির কারনে কোথাও আটকা পড়েছিল। বৃষ্টি কমার লক্ষন নাই দেখে ভিজেই রওয়ানা দিয়ে দিল এবং পথিমধ্যে অপ্রত্যাশিত আগন্তুক দেখে জানালা দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।


পরদিন সকাল। তাপস বাবু দেখলেন তিনি একটি বড় খেয়া নৌকার উপর বসে আছেন। নৌকার মাঝিকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কাছে গিয়ে দেখেন মাঝিটি আর কেউ না, আর্নেস্ট হেমিং, বিশ্বখ্যাত রাইটার। কিন্তু এ কি করে হয়। তাপস বাবু নিজেকে ধাতস্ব করতে কিছুটা সময় লাগালেন। মনে মনে ভাবলেন, কদিন ধরে একটি প্যারানরমাল একটিভিটিজ নিয়ে একটি গল্প সাজিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। হয়তো বিরতীহীন চিন্তায় মস্তিস্কে ঘোর-লাগা সৃষ্টি হয়েছে। ঘোরের কারনেই হয়তো মাঝিকে আর্নেস্ট হেমিঙের মত দেখাচ্ছে। তবু কিঞ্চিত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাকে কি আমি চিনি?”
“চেনার তো কথা, আমি আর্নেস্ট হেমিং। আপনার প্রিয় লেখক“, মাঝি বলল।
তাপস বাবু শুকনা গলায় বললের, “কিন্তু এ কি করে হয়। এটা কি স্বপ্নে দেখছি”
স্বপ্ন কিনা এটা প্রমান করার জন্য আনের্স্ট হেমিং পানির ছিটা দিতে লাগলেন। পানির ঝাপটা গায়ে এসে লাগতে লাগল তাপস বাবুর। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ধরমরিয়ে উঠে গেলেন। সামনে নিচৃ হয়ে পরিমল দাড়িয়ে। পানির ছিটা দিয়েই যাচ্ছে সে। পানির ঝাপটা দিয়ে তাপস বাবুর ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাবু, কি এত বেলা করে ঘুমান? অনেকক্ষন ধরে জাগানোর চেষ্টা করছি। ঘরে বাজার নাই, বাজার আনতে হবে। টাকার দরকার। আপনার ঘুম কি ভাল হয়েছে?

তাপস বাবু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। পরিমলের হাত থেকে চায়ের পেয়ালাটি হাতে নিলেন। সাথে একটি সিগারেট ধরালেন। সকালে গরম চায়ের সাথে একটা সিগারেটের সহচর্য না পেলে সকালের আনন্দসূচনা হয় না।

“কাল আসনি কেন?”-তাপস বাবু সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করলেন পরিমলকে।

“ঝড়ের জন্যি বাবু, ঝড়ের জন্য পেছনের একটা বেড়া ভেঙ্গে পড়াতে আর আসা সম্বব হয়ে ওঠেনি”।

পরিমল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কি করব বাবু, একমাত্র সম্বল নিজের ভিটেমাটিটি চেয়ারম্যানের কাছে বন্ধক দিযেছিলাম তিন বছর আগে। পরে সময়মতো চক্রসুদের টাকা ফেরত দিতে পারি নাই বলে চেয়ারম্যান পুরো ভিটেটাই দখল করে নিল। পরে অনেক চেষ্টা করেও এটা উদ্ধার করতে পারিনি। আর দেখেন, এখন সেই চেয়ারম্যানের একটা বাড়িতেই ভাড়া থাকতে হচ্ছে। বিধির খেল বাবু, সবই বিধির খেল। আর সেই ভাড়া বাড়ির কিছু হলে তো এখানেও ঠাঁই দেবে না। রাস্তায় গিয়ে থাকতে হবে বৌ-বাচ্চা নিয়ে।

তাপস বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “বন্ধকের টাকা কেন নিয়েছিলে?”

পরিমল মুখ কালো করে বলল, “ছোট মেয়েটার এক্লেমশিয়া হয়েছিল তখন, বাবু। চিকিৎসার জন্যি অনেক টাকা দরকার ছিল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে বাচাঁতেও পারলাম না”। আফসোস। বলেই ডুকঁরে কাদাঁ শুরু করল পরিমল।

তাপস বাবু তাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা বের করে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিলেন তার হাতে তাকে ব্যস্ত করে তুলার জন্য। ব্যস্ততা মানুষের সকল দু:খ-কষ্টকে নিমিষেই ভুলিয়ে দিতে পারে।

(চলবে)
আরেকটু পড়ি, কি বলেন.......